দেশজুড়ে

বাকশাল কি ভুল ছিল? ইতিহাস ও সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টি

আজহারুল ইসলাম শিমুল, নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত রাজনৈতিক রূপকল্পটি হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল গঠন। ১৯৭৫ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, সিপিবি, ন্যাপ (মোজাফফর) এবং জাতীয় লীগ তাদের নিজস্ব দল বিলুপ্ত করে সোভিয়েত ধাঁচে বাকশাল গঠন করে।

সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মত বাকশালেও সরকারী কর্মকর্তা এবং ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে যোগদান করতে বাধ্য করা হয় এবং সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২৫ জানুয়ারী সংসদে দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে বাকশাল গঠনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনে।

চতুর্থ সংশোধনীর মূল আবেদনটা ছিল উপনিবেশিকতার সূত্রে প্রাপ্ত পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ধারার বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির আদলে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং এর মাধ্যমে অর্থনীতির সমস্ত চালিকা শক্তি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়া। একে মনে করা হত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে এক ব্যক্তির হুকুমে এবং সমস্ত কল কারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করবেন আমলারা।

এ ধরণের ব্যবস্থায় প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তাত্ত্বিকভাবে থাকবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আর বাস্তবে থাকবে ক্ষ্মতাসীন দলটির হাতে। মিডিয়াতে ক্ষমতাসীন দলের চিন্তা চেতনার বাইরে কোন মত প্রকাশ করা যাবে না এবং দল প্রধান ও দলের কোন কাজের সমালোচনাও করা যাবে না।

ওসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনসহ যেকোন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করত যাতে তাদের নিজ দেশটিকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দেশ মনে হয়। এ সমস্ত দেশে কোন বিরোধী দল, ছাত্র সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন ছিল না। সিভিল সোসাইটি ছিল রাষ্ট্রের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত। লেখনী বা অন্য কোন মাধ্যমে ওসময় সরকার, রাষ্ট্র বা কমিউনিস্ট পার্টির কোন অসঙ্গতি যারা তুলে ধরতে চেয়েছেন তাঁদের সবাইকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল বা পুঁজিবাদের প্রতিভূ আখ্যায়িত করে জেল, ফাঁসি বা নির্বাসন এসব দণ্ড দেওয়া হয়েছে।

খুব অদ্ভুত ব্যাপার হল আওয়ামী লীগের মত পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠন করে কেউ যাতে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করতে না পারে তার জন্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মতই ১৯৭৫ সালের জুন মাসে চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে দেয়। এ নিষিদ্ধের খড়গ ‘সোভিয়েত ঘেঁষা’ হিসাবে পরিচিত সংবাদপত্র ‘ দৈনিক সংবাদ’ এর উপরেও পরে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে সমস্ত মিডিয়া যেমন সার্বক্ষণিক নেতা এবং দলের বন্দনা করত, তেমনি বাকশাল নেতৃবৃন্দও বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাচ্ছিলেন বলে আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হয়।

বাকশাল নিয়ে সাধারণ মানুষের অসন্তুষ্টি

বাকশালকে কৃষক শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি হিসাবে তুলে ধরেন এর সমর্থকরা।

কিন্তু সে সময় বাকশাল নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছিল এবং সেজন্য এর পক্ষে জনসমর্থন পায়নি বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলছিলেন, বাকশালের আদর্শের ভিত্তিতে এবং সাংগঠনিক কাঠামোতে দুর্বলতা ছিল। তিনি বলেন, “এটা মূলত আদর্শের ভিত্তিটা অত্যন্ত দুর্বল ছিল। কারণ বাকশালের মতো একটা ওয়ান পার্টি স্টেট করতে হলে সেই পার্টিটার গ্রাম গঞ্জ সর্বত্র একেবারে কমিউনিস্ট পার্টির মতো মানুষের মাঝে ঢুকে যেতে হয়।

তিনি আরও বলেন, “আদর্শের ভিত্তিটাকে একেবারে স্ট্রং করে নিয়ে আসতে হয় গ্রাসরুট লেভেল থেকে। সেই ভিত্তিটাতো ছিল না। সেজন্য জনগণের মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছিল।”

বাকশাল কী ভুল ছিল?
বাকশাল প্রতিষ্ঠা একটা ভুল পদক্ষেপ ছিল বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।

তবে আওয়ামী লীগ বাকশালকে সেসময় জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির জন্য আদর্শ ভিত্তিক কর্মসূচি হিসেবে তুলে ধরে এসেছে এত বছর।

নূহ আলম লেনিন বলছিলেন, বাকশাল পুরোপুরি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে। তার আগেই পট পরিবর্তনের কারণে এর ভালমন্দ দেখার সুযোগ হয়নি বলে তিনি মনে করেন।

“এটা ভুল কি শুদ্ধ যদি বলেন,সেটা মূল্যায়ন করার সময়তো আমরা পেলাম না। এই নতুন সিস্টেম কার্যকর হওয়ার আগেইতো তাঁকে হত্যা করা হলো। সময়তো তিনি পাননি। কাজেই এটা সফল হয়েছে নাকি ব্যর্থ হয়েছে – এটা মূল্যায়ন করার সুযোগ কিন্তু আমরা পাইনি।”

বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বাকশালের সমর্থনে যুক্তি দিয়ে এর ইতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিন বছর যেতে না যেতেই তিনি কেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ থেকে একদলীয় শাসনের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠলেন, সেটা কি শুধু শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য, নাকি এর পেছনে আরও কোনো ‘রাজনীতি’ ছিল? বাকশাল কি একটি সাময়িক ব্যবস্থা ছিল, নাকি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার স্থায়ী পদক্ষেপ ছিল? এসব প্রশ্নের আসল উত্তর জানা সম্ভব হবে না কোনোদিন। কারণ এ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজের কোনো বয়ান নেই।

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close