দেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
মোবাইলে পরকীয়া, বিয়ে এড়াতে মা-মেয়েকে হত্যা
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: মোবাইলে যোগাযোগ করে মাধুরী নামের এক গৃহবধূর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন বিধান দাস। মাধুরী তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে অস্বীকৃতি জানান। পরে মাধুরী তার মেয়েসহ বিধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে ‘পরকীয়ার কাঁটা সরাতে’ মা-মেয়েকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছে বলে জবানবন্দি দিয়েছেন অভিযুক্ত বিধান দাস।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ জবানবন্দির কথা জানানো হয়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, গত ৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ বক্সের ডিউটি অফিসার কোতোয়ালি থানায় ফোন করে জানান, রাজধানীর সদরঘাট থেকে সালাউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি অচেতন অবস্থায় এক নারী ও তার শিশু সন্তানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেখে চলে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক অজ্ঞাতনামা নারীকে মৃত ঘোষণা করেন এবং শিশু সন্তানটিকে অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করেন।
সংবাদ পেয়ে কোতোয়ালি থানা পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায় এবং ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে ওই নারীর পরিচয় শনাক্ত করে। ওই নারীর স্থায়ী ঠিকানা বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাটে যোগাযোগ করা হলে তার ভাই হাসপাতালে এসে মরদেহ শনাক্ত করেন এবং জানা যায়, তার নাম মাধুরী বিশ্বাস (৩৬) ও চিকিৎসাধীন তার কন্যাশিশু শ্রেষ্ঠা (৭)।
সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ ভিকটিমের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং চিকিৎসাধীন শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে তারা হাসপাতাল ত্যাগ করে। ওই ঘটনায় ৬ ডিসেম্বর ভিকটিমের বড় ভাই নারায়ণ বিশ্বাসের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা রুজু করা হয়।
অপমৃত্যু মামলা রুজু হওয়ার পর থানা পুলিশ ঘটনাটির তদন্ত শুরু করে এবং জানতে পারে আট বছর আগে খুলনা জেলার তেরখাদা থানার পিংকু মজুমদারের সঙ্গে মাধুরী বিশ্বাস বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের সাত বছরের একটি মেয়েশিশু রয়েছে। মেয়ে শ্রেষ্ঠাসহ মাধুরী বিশ্বাস গত ২৮ নভেম্বর সকালে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বাগেরহাটের উদ্দেশে রওনা হন। এরপর মাধুরী ও তার মেয়ের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
অপমৃত্যু মামলা রুজু হওয়ার পর তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় কোতোয়ালী থানা পুলিশ বিধান দাস নামে একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির সন্ধান পায়। এরই প্রেক্ষিতে পুলিশ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে বিধান দাসকে মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) রাত ৩টায় মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়ার থ্রি-অ্যাঙ্গেল ডক এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। এ সময় তার থেকে দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার বিধান দাস পুলিশকে জানান, তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার দশমিনা এলাকায়। তিনি একটি বাল্কহেডের ইঞ্জিন শ্রমিক। ঘটনার চার-পাঁচ মাস আগে তার জাহাজের একজন কর্মচারীর কাছ থেকে মাধুরীর মোবাইল নম্বর পান এবং তাকে কল করেন। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠে এবং সম্পর্ক পরকীয়ায় রূপ নেয়। মাধুরী বিধানকে বিয়ের জন্য চাপ দেন কিন্তু তিনি রাজি হন না।
বিধান আরও জানান, তিনি ছুটিতে বরিশাল যেতে চাইলে মাধুরীও তার সঙ্গে যাওয়ার কথা জানান। ২৮ নভেম্বর মাধুরী বাবার বাড়ি বাগেরহাট যাওয়ার জন্য বের হয়ে মেয়ে শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে খুলনা থেকে বাসযোগে বরিশাল যান এবং একইদিনে বিধান ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশে রওনা দেন। ওইদিন বিকেল ৩টায় বরিশালের নতুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ডে তাদের দেখা হয় এবং স্থানীয় এক আবাসিক হোটেলে রুম ভাড়া নিয়ে অবস্থান করেন।
২৯ নভেম্বর বিধান মাধুরীকে হোটেলে রেখে পটুয়াখালী যান। এরইমধ্যে বিধান তার পারিবারিক কাজ নিয়ে ব্যস্ততার কথা বলে পটুয়াখালী অবস্থান করেন এবং মাধুরীকে জানান তিনি যেন পটুয়াখালী চলে আসেন। সেখান থেকে তারা একসঙ্গে ঢাকা যাবেন। এদিকে বিধান পরিকল্পনা সাজাতে থাকেন কীভাবে মাধুরীকে তার জীবন থেকে সরানো যায়। ৪ ডিসেম্বর সকাল বেলা দশমিনা বাজারের নলখোলা বন্দরের একটি দোকান থেকে ঘাস মারার কীটনাশক ওষুধ কিনেন।
বিধান ৪ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টায় মাধুরী ও তার মেয়ে শ্রেষ্ঠাসহ কালাইয়া লঞ্চঘাটে আসেন এবং বিধান লঞ্চের একটি কেবিন ভাড়া করেন। কেবিনে উঠার কিছু সময় পর মাধুরী শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে বাথরুমে গেলে বিধান পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী তার পকেটে থাকা বিষ একটি পানির বোতলে ভরে কেবিনের বক্সে রেখে দেন। লঞ্চ ছাড়ার পর খাওয়া-দাওয়া শেষে শ্রেষ্ঠা ঘুমিয়ে পড়লে বিধান ও মাধুরীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয় এবং বিধান মাধুরীকে গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ বলে বিষ মেশানো পানি পান করতে দেন।
মাধুরী জানান যে, শ্রেষ্ঠারও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে তাই ওকেও ঘুম থেকে ডেকে বিষ মেশানো পানি খাওয়ান। ওষুধ খাওয়ার পর দুজনই দুইবার বমি করেন। এতে মাধুরী ও শ্রেষ্ঠা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন। পরদিন ৫ ডিসেম্বর সকাল ৫টায় সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছাতে বিধান মাধুরী ও শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে টার্মিনালে আসেন। তাদেরকে এক জায়গায় বসিয়ে খাবার আনার কথা বলে বিধান যাত্রাবাড়ী তার জাহাজে চলে যান।
পরবর্তীতে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের ৪ নম্বর গেটের সামনে তাদেরকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চিকিৎসার জন্য সকাল ৯টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মাধুরীকে মৃত ঘোষণা করেন এবং তার শিশু কন্যা শ্রেষ্ঠাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। চিকিৎসার সুবিধার্তে শ্রেষ্ঠাকে তার আত্মীয়স্বজন গোপালগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে ১৪ ডিসেম্বর সে মারা যায়।
উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, গ্রেফতার বিধানদাসকে আসামি করে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা রুজু করা হয়েছে। এরইমধ্যে তাকে বিজ্ঞ আদালতে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং ঘটনার দায় স্বীকার করে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।