প্রধান শিরোনাম
খালে পাওয়া গেল এমপি আনারের লাশের টুকরো
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: ভারতে গিয়ে নিখোঁজ ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। পশ্চিমবঙ্গ ও ঢাকার পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে— পশ্চিমবঙ্গের নিউটাউন এলাকার একটি ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয়েছে এমপি আনারকে। এরপর গুম করতে লাশটির চামড়া ছাড়িয়ে ৮০ টুকরো করা হয়েছে। হাড়গুলো আলাদা করে ফেলে দেওয়া হয়েছে খাল ও বিভিন্ন জায়গায়। যদিও দাবির পক্ষে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি উভয় দেশের পুলিশ। ফলে প্রশ্ন উঠছে, লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলে দেওয়া হলে; মাথার খুলি আর এমপি আনারের পোশাক গেল কোথায়?
দাবি করা হত্যার রহস্য উদঘাটনে জোর অনুসন্ধান চালাচ্ছে উভয় দেশের পুলিশ। সিআইডি ও ডিবির সমন্বিত তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা গেছে— এখন পর্যন্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত এমন চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, শিলাস্তি রহমান ও তানভীর ভূঁইয়াকে আটদিন করে রিমান্ড দিয়েছেন ঢাকার আদালত। এছাড়া জিহাদ হাওলাদার ওরফে কসাই জিহাদের ১২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত আদালত।
উপকূলজুড়ে ক্ষত উপকূলজুড়ে ক্ষত রেখে গেল রেমাল
রেখে গেল রেমাল
বিস্তারিত পড়ুন
এদিকে এমপি আনার হত্যার রহস্য উদঘাটনে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান করছে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম। সেখানে ভারতীয় রাজ্য পুলিশের হেফাজতে থাকা জিহাদ হাওলাদারকে দিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করানো হয়েছে। পুনর্নির্মাণে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ জানতে পেরেছে— আনারের পোশাক, মোবাইল ফোন কোথায় ফেলা হয়েছিল এবং দেহ থেকে খুলি আলাদা করে টুকরো করার পরে তাই-বা কোথায় ফেলেছিল হত্যাকারীরা।
ঘটনার পুনর্নির্মাণ হলো কীভাবে?
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদ জানান, আনার হত্যার ঘটনাটি পুলিশের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছে জিহাদ। তার কথায়— পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি তাকে সোমবার ঘটনার পুনর্নির্মাণের জন্য ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিল, আমরাও সেখানে ছিলাম।
এর আগে রোববার কলকাতায় এসে সন্ধ্যা থেকে বেশ কয়েক ঘণ্টা পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির হেফাজতে থাকা অন্যতম অভিযুক্ত জিহাদকে নিজে জেরা করেন ডিবিপ্রধান হারুন। এরপর জিহাদকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সদর দফতর থেকে নেওয়া হয় নিউটাউনের সেই ফ্ল্যাটে। সেখানে তার সঙ্গে ঢাকায় গ্রেফতার আসামিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলানো হয়। তাদের একসঙ্গে জেরাও করা হয় বেশকিছু সময়।
ঘটনার পুনর্নির্মাণে যা জানা গেল
জিহাদের বর্ণনা অনুযায়ী, ফ্ল্যাটটি ডুপ্লেক্স। ১৩ মে দুপুর ৩টা পর্যন্ত ফয়সাল এবং আমানুল্লাহর সঙ্গে এমপি আনার ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। তারা ফ্ল্যাটে ঢোকার সময় তৃতীয় অভিযুক্ত শিলাস্তি রহমান ওপরের তলায় ছিলেন। জিহাদ এবং সিয়াম ছিলেন নিচের অংশেরই ভেতরের একটি ঘরে। এমপি ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশের পরেই ক্লোরোফর্ম ভেজানো কাপড় তার মুখে চেপে ধরা হয় এবং তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয় ফ্ল্যাটের রান্নাঘর সংলগ্ন জায়গায়।
সিআইডির ওই কর্মকর্তা বলছিলেন— ফ্ল্যাটের যে হলঘর, অর্থাৎ বসার এবং খাওয়ার জায়গা, সেখানে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেটি খুনের আগে, অর্থাৎ ৭ মে দুপুরের দিকে শিলাস্তি রহমান কাপড় আর লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে ঢেকে দেন। তবে এর আগে সেই সিসিটিভির ফুটেজ কার কাছে আছে তা স্পষ্ট নয়।
পুলিশের কাছে জিহাদের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, রান্নাঘর সংলগ্ন জায়গায় হত্যা করা হয় এমপি আনারকে। এরপর মরদেহ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। হাড় এবং মাংস আলাদা করে ফেলা হয়। এ সময় শরীর মাথাও কেটে ফেলা হয়। পরে জিহাদ দেহের মাংস আর মাথার খুলি টুকরোও করেন। এই কাজে তিনি চপার জাতীয় ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। যে অস্ত্রটি স্থানীয়ভাবে কিনে এনেছিলেন আমানুল্লাহ। এরপর দেহের টুকরোগুলো ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে ফেলা হয়।
মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন— আমরা ওই বাড়িতে দাঁড়িয়ে বর্ণনা শুনলাম, কীভাবে এমপিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। শুধু হত্যা করা হয়নি, লাশটাকে যাতে গুম করা যায়, তার জন্য শুনলাম কীভাবে শরীর থেকে মাংস আলাদা করা হয়েছে। একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি ওই বর্ণনা শুনে মানতে পারছিলাম না; এতটা নিষ্ঠুর, এত পাষাণ তারা!
এমপির পোশাক কোথায় গেল?
সিআইডির ওই অফিসার বলছেন, ঘটনার পুনর্নির্মাণের সময়ে জিহাদ জানিয়েছে— মরদেহের টুকরোগুলো প্যাকেট করার পর সেগুলো নিয়ে ভাঙরের কৃষ্ণমাটি সেতুর দিকে গিয়েছিলেন জিহাদ। এ সময় তার সঙ্গে দেহ টুকরো করার অস্ত্র এবং আনোয়ারুলের পোশাক এবং মোবাইল নিয়ে যান।
ডিবি কর্মকর্তা জানান, মোবাইল এবং আনারের পোশাক দেওয়া হয় গাবতলা বাজার নামক জায়গার বাগজোলা খালে।
সিআইডি এবং ডিবিপ্রধানের সামনে জিহাদ জানিয়েছে— সেখান থেকে আরও এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণমাটি সেতুর কাছে একটি বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে নিচে নেমে দেহাংশ ভরা প্যাকেটগুলো খালের পানিতে ফেলে দেয় সে। সঙ্গে দেহ টুকরো করার কাজে ব্যবহৃত চপারটিও। যদিও ওই জায়গায় তিনদিন ধরে ডুবুরি আর নৌকা নামিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে সিআইডি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেসব জিনিসের হদিস পাওয়া যায়নি।
ডিবিপ্রধান হারুন জানান, জিহাদকে নিয়ে আমরা খালের পাড়ে এসেছি। কোন জায়গায় তারা লাশটাকে ফেলেছিল সেটা আমরা দেখছি। কীভাবে এটা উদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে আমরা মিটিংও করেছি। আমরা মনে করি— দ্রুতই মরদেহ অথবা দেহের অংশবিশেষ আমরা উদ্ধার করতে পারব।
খুলির টুকরো নিয়ে অন্য পথে ফয়সাল
জিহাদ যখন দেহাংশগুলো, অস্ত্র, মোবাইল এবং পোশাক নিয়ে ভাঙরের দিকে রওনা হয়; তখন অন্য একটি রাস্তা ধরে মাথার খুলির টুকরোগুলো নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার দিকে রওনা হয়েছিল ফয়সাল— এমনটিই জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা।
তদন্তকারীরা জেনেছেন, উত্তর ২৪ পরগনারই শাসন অঞ্চলে মাথার খুলির টুকরোগুলো ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তথ্য অনুযায়ী মোট তিনটি জায়গায় আলাদাভাবে দেহ লোপাট করা হয়েছে। সরিয়ে ফেলা হয়েছে অন্যান্য প্রমাণও। এরপর এমপির ভারতীয় মোবাইলটি নিয়ে বিহার হয়ে নেপালের পথে রওনা হয়েছিল আরেক অভিযুক্ত সিয়াম। সেই সিমটি কয়েকবার অ্যাক্টিভেটও করেছিলেন তিনি। সেখান থেকে কলকাতায় আনারের বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকে কয়েকবার মেসেজ পাঠান তিনি। এছাড়া বাংলাদেশে সংসদ সদস্যের সহকারীর কাছেও ফোন করে একবার।
আনোয়ারুল আজিম নিখোঁজ হওয়ার পরে তার মোবাইল নম্বর ট্র্যাক করতে গিয়ে মুজফ্ফরপুরে লোকেশন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বলে জানিয়েছেন কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের এক কর্মকর্তা। তখনও তার খুন হওয়ার খবর জানা ছিল না কারও।
তদন্তকারীরা বলছেন— এটাও সম্ভবত খুনের মূল পরিকল্পনারই অংশ ছিল, যাতে আনারের পরিবার এবং বন্ধুরা বুঝতেই না পারেন যে তিনি নিরুদ্দেশ। সুচারুভাবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে যাতে পালিয়ে যেতে পারে, তার জন্য সময় নিচ্ছিল হত্যাকারীরা।
সূত্র: বিবিসি