আমদানি-রপ্তানীপ্রধান শিরোনামবিশ্বজুড়ে
ভোজ্যতেলের দাম কমেই চলেছে আন্তর্জাতিক বাজারে
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: ভোজ্যতেলের ব্যবহার ও আমদানিতে গোটা বিশ্বে চীনের অবস্থান শীর্ষে। দেশটির ভোক্তাদের ভোগপ্রবণতায় লাগাম টেনে ধরেছে করোনার নতুন প্রবাহ ও এর ধারাবাহিকতায় দেয়া লকডাউন। আবার বিশ্বব্যাপী সয়াবিন ও পাম অয়েলের উৎপাদনও এখন বাড়ছে। একদিকে চাহিদা হ্রাস, অন্যদিকে উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধির খবরে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের ভোজ্যতেলের মূল্যহ্রাস অব্যাহত রয়েছে বেশ কয়েকদিন ধরেই।
মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ বিপণনবর্ষে সয়াবিন তেলের বৈশ্বিক উৎপাদন বাড়বে ৪ শতাংশ। অন্যদিকে পাম অয়েলের দুই শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পাম উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসার পাশাপাশি শ্রমিক সংকট কেটে যাওয়ারও জোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সে অনুযায়ী ২০২২-২৩ বিপণনবর্ষে পাম অয়েলের উৎপাদন বাড়বে ৩ শতাংশ। বাজার পর্যবেক্ষণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাও প্রায় একই রকম পূর্বাভাস দিয়েছে।
শীর্ষ বাজারে ভোক্তা চাহিদা কমার পাশাপাশি এসব পূর্বাভাসের প্রভাবে প্রায় সব ধরনের ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজারদর এখন নিম্নমুখী। সর্বশেষ গতকাল একদিনে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে টনপ্রতি ৮২ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) গতকাল প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম নেমে আসে ১ হাজার ৬৩০ ডলারে। আগের দিনও তা কেনাবেচা হয়েছে টনপ্রতি ১ হাজার ৭১২ ডলারে। এক সপ্তাহ আগে এর মূল্য ছিল প্রতি টন ১ হাজার ৭৮১ ডলার। সে হিসেবে একদিনে পণ্যটির দাম কমেছে ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সপ্তাহে কমেছে প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ।
নিম্নমুখী প্রবণতা বজায় রয়েছে পাম অয়েলের দামেও। এক সপ্তাহ আগেও সিবিওটিতে পণ্যটির মূল্য ছিল প্রতি টন ১ হাজার ৩৬০ ডলার। বৃহস্পতিবার তা বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৩২৮ ডলারে। সেখান থেকে গতকাল নেমে এসেছে ১ হাজার ৩১৯ ডলারে। ভোজ্যতেলটি এর চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে কুয়ালালামপুরের বুর্সা মালয়েশিয়া ডেরিভেটিভস এক্সচেঞ্জে। সেখানে গতকাল দিনশেষে পণ্যটির মূল্য নেমে এসেছে প্রতি টন ৫ হাজার ৪৫৬ রিঙ্গিতে (১ হাজার ২৪০ ডলারের সমপরিমাণ)। গত এক সপ্তাহে বুর্সা ডেরিভেটিভসে পণ্যটির দাম কমেছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এর আগের সপ্তাহে দরপতনের হার ছিল ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। উৎপাদন বৃদ্ধির পূর্বাভাসের পাশাপাশি শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া এখন পাম অয়েলের রফতানি বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। একই পথে হাঁটছে মালয়েশিয়াও। বাজারে এখন এরই প্রভাব স্পষ্ট বলে জানিয়েছেন বুর্সা ডেরিভেটিভসের ট্রেডাররা।
বাজার-সংক্রান্ত প্রায় সব পূর্বাভাসেই বলা হচ্ছে, ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজারের নিম্নমুখিতা অব্যাহত থাকবে আরো বেশ কিছুদিন। শিগগিরই এ পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এর ভিত্তিতে দেশে দেশে ভোক্তা বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমানোর ঘোষণা দিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও গত বৃহস্পতিবার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল, পাম অয়েল ও সূর্যমুখী তেলের দাম লিটারে ৫ থেকে ১৫ রুপি পর্যন্ত কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে। গত ১১ জুন সরকারিভাবে ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েলের লিটারপ্রতি দাম ১৪ টাকা কমানো হলেও সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারে ৭ টাকা। শিগগিরই দেশে ভোজ্যতেলের দাম কমছে না বলে জানিয়েছেন বাজারের নীতিনির্ধারকরা।
ভোজ্যতেলের আমদানি, পরিশোধন ও বিপণন কার্যক্রমকে ‘বিশেষায়িত’ আখ্যা দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দ্রুততম সময়ের ব্যবধানে দাম সমন্বয়ের সুযোগ নেই। গত এক সপ্তাহে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম টনপ্রতি প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ ডলার পর্যন্ত কমলেও এর সুফল পেতে দেশের ভোক্তাদের অপেক্ষা করতে হবে অন্তত দেড় মাস। বিশ্ববাজারের প্রভাব বিশ্লেষণ করে আগামী কোরবানির ঈদের আগে দাম সমন্বয় করা হবে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সদস্য শাহ মো. আবু রায়হান আলবেরুনী বণিক বার্তাকে বলেন, ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন, ভোজ্যতেল আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি রয়েছে। কমিটির সদস্যরা বৈঠকের মাধ্যমে বিগত কয়েক মাস আগে আমদানি হওয়া ইনবন্ড-আউটবন্ড ভোজ্যতেলের তথ্য পর্যালোচনা করে দাম নির্ধারণ করে। এজন্য একটি সূত্র মেনে চলা হয়। যার কারণে বর্তমান সময়ে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও এর সুফল পেতে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়। সর্বশেষ দাম সমন্বয় হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। নতুন দাম ঘোষণা করতে অন্তত আরো এক মাস লাগবে।
আমদানিকারক ও মোড়কজাতকারী কোম্পানিগুলো সরকারের নির্দেশনার ভিত্তিতে দাম সমন্বয়ে সময় নিচ্ছে অন্তত পাঁচ সপ্তাহ। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাসের প্রভাবে আমদানিকারকরা লাভবান হলেও কোনো সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ভোজ্যতেল আমদানি হয় মূলত ফিউচার মার্কেট থেকে ভবিষ্যৎ সরবরাহের চুক্তির ভিত্তিতে। স্পট মার্কেটের তাত্ক্ষণিক সরবরাহের চুক্তিতে কেনা পণ্যের চেয়ে এর দাম সাধারণত কম হয়। সে হিসেবে দেশের বাজারে এখন যে ভোজ্যতেল আসছে, তা মূলত কয়েক মাস আগে কেনা। অথচ সরকার বিশ্ববাজারের এক মাস আগের মূল্য পর্যালোচনা করে দেশের বাজারে দাম নির্ধারণ করছে। এতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভোক্তারা।
এছাড়া এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতি ১৫ দিন পর পর ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণের দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু এক মাস বা তারও বেশি সময় পর মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি ভোক্তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। এতে বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশে ভোজ্যতেলের সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ে গত ঈদুল ফিতরের পর। গত ৫ মে ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি এক লাফে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করে কোম্পানিগুলো। পাশাপাশি খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দামও বাড়িয়ে দেয়া হয়। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা কমে এলে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত দাম কমানোর প্রত্যাশা তৈরি হয়। কিন্তু গত ১১ জুন সরকারিভাবে ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েলের লিটারপ্রতি দাম ১৪ টাকা কমানো হলেও সয়াবিনের দাম ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ হিসেবে বাজারে এখন বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটারপ্রতি সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য দাঁড়িয়েছে ২০৫ টাকায়।
বিশ্বব্যাপী দেশগুলো মহামারীর প্রাদুর্ভাবজনিত স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার পর পরই বৈশ্বিক ভোক্তা চাহিদায় আকস্মিক উল্লম্ফন দেখা দেয়। বাড়তি চাহিদার তুলনায় মজুদ ও উৎপাদন কম থাকায় গত বছর ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য বাড়তে থাকে অস্বাভাবিক হারে। বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর প্রায় দেশেই এর প্রভাব দেখা যায়। চীন-ভারতসহ পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের শীর্ষ ভোক্তা দেশগুলো এ সংকট মোকাবেলা করেছে শুল্কহারে ছাড় দেয়ার মাধ্যমে। যদিও বাংলাদেশ এ শুল্কহার কমানোর ক্ষেত্রে কিছুটা হিসেবি আচরণ দেখায়। এতে গত এক বছরে দেশে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে অন্তত ১০ বার।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েলের দাম লিটারপ্রতি ১৪ টাকা কমানো হলেও বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। দেশে ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এখন পাম অয়েল মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ৬ হাজার ৫০০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। সে হিসেবে পাইকারিতে প্রতি লিটার পাম অয়েলের দাম পড়ছে ১৭৪ টাকা করে। খুচরা তা বিক্রি হচ্ছে আরো অন্তত ৪-৫ টাকা বেশি দামে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের ভোজ্যতেল বাণিজ্য পাঁচ থেকে সাতটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। আগেও বেশকিছু প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ছিল, যারা ঋণখেলাপের দায়ে মার্কেট থেকে সরে গেছে। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট বাণিজ্য ভোজ্যতেলের বাজারে প্রভাব বিস্তার করায় বৈশ্বিক দর ওঠানামার সঙ্গে দেশের বাজারে দাম নির্ধারণের সামঞ্জস্য দেখা যায় না। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও সংকটকালে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে শুধু দাম বেঁধে দিলে হবে না। এর সঙ্গে তথ্য সরবরাহ ও অতিমুনাফার ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানও নিতে হবে। এছাড়া প্রতিযোগিতা কমিশনকেও আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে।
নাম প্রকাশ না করে ভোজ্যতেল আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের একজন বণিক বার্তাকে বলেন, গত রোজার আগে দেশীয় ভোক্তাদের ওপর বাড়তি দাম চাপিয়ে না দিতে কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যার কারণে ওই সময়ে আমদানিকারকরা ভোজ্যতেল বিপণনে বড় ধরনের লোকসান করে। ঈদের পর ব্যবসায়ীদের সে লোকসান পুষিয়ে দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। হতে পারে এ কারণেই বর্তমানে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দর সমন্বয়ে কিছুটা বিলম্ব করছে।
গত রোজার ঈদের পর ৫ মে দেশে ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল। ওই সময়ে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি রেকর্ড ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। এরপর গত ৯ জুন মিল পর্যায়ে ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৮০ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৮২ টাকা ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৯৫ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৯৯ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এক লিটারের খোলা পাম অয়েলের (সুপার) দাম মিলগেটে ১৫৩ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৫৫ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৫৮ টাকা করা হয়। এক্ষেত্রে সয়াবিনের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারপ্রতি ৫-৭ টাকা। পাম অয়েলের দাম কমানো হয়েছে লিটারপ্রতি ১৪ টাকা।
/একে