প্রধান শিরোনামশেয়ার বাজার
করোনার প্রকোপের মধ্যেও রমরমা ব্যবসা বহুজাতিক কোম্পানির!
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ (কোভিড-১৯) প্রকোপের মধ্যেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ বহুজাতিক কোম্পানি ভালো মুনাফা করেছে। মুনাফার সঙ্গে কোম্পানিগুলোর সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে। বেশিরভাগ কোম্পানির পরিচালন নগদ প্রবাহও ভালো অবস্থানে রয়েছে। তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
নিয়ম অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিন মাস পরপর তাদের ব্যবসার লাভ-ক্ষতির তথ্য প্রকাশ করতে হয়। সেই সঙ্গে তিন মাসের আর্থিক তথ্যও তুলে ধরতে হয়। তারই অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত ১০টি বহুজাতিক কোম্পানি চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ের আর্থিক তথ্য প্রকাশ করেছে। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এখনো জানুয়ারি-মার্চ সময়ের ব্যবসার তথ্য প্রকাশ করতে পারেনি।
ব্যবসার তথ্য প্রকাশ করা কোম্পানিগুলোর মধ্যে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করেছে রেকিট বেনকিজার। ১৯৮৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটি ডেটল, মরটিন, হারপিক, ভ্যানিশ, লাইজল ও ভিটসহ কয়েকটি প্রসাধন পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে বছরের পর বছর ধরে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করে যাচ্ছে। প্রতিটি বছরেই ভালো মুনাফার সঙ্গে শেয়ারহোল্ডারদের ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
নিয়মিত ভালো ব্যবসা করলেও করোনা মহামারির মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফার পালে আরও হাওয়া লেগেছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে কোম্পানিটির মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের ব্যবসায় কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ২৪ টাকা ৪ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৫ টাকা ৪৬ পয়সা। সে হিসাবে মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৫ শতাংশ।
মুনাফায় এমন প্রবৃদ্ধি হওয়ার পাশাপাশি কোম্পানির সম্পদ মূল্যও অঙ্কে বেড়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৬৬ টাকা ৬৮ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৪২ টাকা ৬৪ পয়সা।
এদিকে ২০১৯ সালের লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে বহুজাতিক এই কোম্পানি। রেকর্ড পরিমাণ ১২৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে গিয়ে কোম্পানিটি যে মুনাফা দেখিয়েছে তার অর্ধেকই এসেছে শেষ তিন মাসে। অর্থাৎ বছরের শেষ তিন মাসে বছরের প্রথম নয় মাসের সমান মুনাফা হয়েছে।
এ কোম্পানিটিরও স্বল্প সংখ্যক শেয়ার রয়েছে পুঁজিবাজারে। প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ আছে দেশীয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে আছে ৮২ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং বিদেশিদের কাছে আছে ৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। অর্থাৎ এ কোম্পানিটি যে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে তার সিংহভাগ চলে যাবে দেশের বাইরে।
মুনাফায় বড় প্রবৃদ্ধি লাভকারী আরেক বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো। ডানহিল, লাকি স্ট্রাইক, কেন্ট, পলমল, কুল, বেনসন এবং রথম্যান্সের মতো তামাকজাত পণ্যের উৎপাদনকারী এ প্রতিষ্ঠান সারাবিশ্বে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে। তামাকজাত পণ্য বিক্রির দিকে থেকে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ প্রতিষ্ঠান।
বেনসন ও পলমল সিগারেটের মাধ্যমে বাংলাদেশের বাজারে বড় ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা কোম্পানিটি প্রতিবছরই ভালো মুনাফা করছে। ফলে নিয়মিত ভালো লভ্যাংশ পাচ্ছেন শেয়ারহোল্ডাররা। মহামারি করোনার মধ্যেও কোম্পানিটির রমরমা ব্যবসা থেমে নেই। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ১৬ টাকা ৮৭ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১১ টাকা ৪৪ পয়সা। অর্থাৎ মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৭ শতাংশ।
মুনাফায় বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে আরেক বহুজাতিক কোম্পানি গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন বা জিএসকের। হরলিকস, মালটোভার মত জনপ্রিয় হেলথ ড্রিংক এবং গ্ল্যাক্সোজ-ডি, সেনসোডাইনের মত জনপ্রিয় পণ্যগুলো নিয়ে এ কোম্পানিও দীর্ঘদিন ধরে দাপটের সঙ্গে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। তবে সম্প্রতি আরেক বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার প্রতিষ্ঠানটি কিনে নিয়েছে।
বিক্রি হয়ে যাওয়ার আগে গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের আর্থিক চিত্র প্রকাশ করে গেছে। কোম্পানিটির ওই আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুয়ায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ১৪ টাকা ৯৭ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১১ টাকা ৬ পয়সা। অর্থাৎ মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ।
গ্যাস ও প্রকৌশল পণ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা করা লিন্ডে বিডি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশেও ভালো ব্যবসা করছে। ভালো ব্যবসার সঙ্গে নিয়মিত মোটা অংকের লভ্যাংশ দেয়ায় এ কোম্পানিটির শেয়ার বিনিয়োগকারীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়েও কোম্পানিটির মুনাফার ধারা অব্যাহত রয়েছে। ফলে তিন মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ২০ টাকা ৩৬ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৮ টাকা ২৬ পয়সা।
বকেয়া পাওনা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধ চললেও টেলিযোগাযোগ খাতে দেশের বাজারে আধিপত্য বিস্তার করা গ্রামীণফোনও জানুয়ারি-মার্চ সময়ে মুনাফা করার দিক থেকে পিছিয়ে নেই। আগের বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ২৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭ টাকা ৯২ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করে ৬ টাকা ২৬ পয়সা।
আগের বছরের তুলনায় মুনাফা বাড়ার তালিকায় আরও রয়েছে লাফার্জহোলসিম। সিমেন্ট খাতের এই কোম্পানি চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৪৫ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩১ পয়সা।
বেশিরভাগ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করলেও বাটা সু, সিঙ্গার বিডির মতো বড় প্রতিষ্ঠানের মুনাফায় ধাক্কা লেগেছে। এর সঙ্গে হাইডেল বার্গ সিমেন্ট ও আরএকে সিরামিকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে হাউডেল বার্গ সিমেন্টের। জানুয়ারি-মার্চ সময়ের ব্যবসায় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে মাত্র ৭৭ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩ টাকা ৪২ পয়সা।
মুনাফায় বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে চামড়ার জুতা নিয়ে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করা বাটা সু’র। প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ২ টাকা ৭ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩ টাকা ২৬ পয়সা। এছাড়া সিঙ্গার বিডির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ১ টাকা ২৩ পয়সা থেকে কমে ১ টাকা ১১ পয়সায় নেমে এসেছে। আরেএকে সিরামিক শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩৫ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪৩ পয়সা।
এ বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. বখতিয়ার হাসান জাগো নিউজকে বলেন, তালিকাভুক্ত কিছু বহুজাতিক কোম্পানি বরাবরই ভালো ব্যবসা করে। তাছাড়া জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের ব্যবসায় করোনার প্রভাব সেভাবে পড়েনি। বরং বাংলাদেশে করোনা দেখা দিলে মার্চে কিছু প্রতিষ্ঠানের কিছু পণ্যের বিক্রি বেশ বেড়ে যায়। যার একটি ইতিবাচক প্রভাবে মুনাফা বেড়েছে।
তিনি বলেন, মার্চের পর থেকে সব ধরনের পণ্যের বিক্রিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সুতরাং জানুয়ারি-মার্চে ভালো ব্যবসা হলেও এপ্রিল-জুন প্রান্তিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ করোনার মূল প্রভাবটা এই তিন মাসে পড়েছে। তবে ওষুধ, জীবাণুনাশক, খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাবটা তুলনামূলক কম থাকবে।
রেকিট বেনকিজারের কোম্পানি সচিব নাজমুল আরিফিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, করোনার কারণে অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কিছু কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। আমাদের ব্যবসায়িক পলিসির কারণেই আমরা ভালো মুনাফা করতে পারছি। তবে করোনার মূল প্রভাবটা পড়বে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে। এই প্রান্তিকে কী হয় সেটাই দেখার বিষয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাটা সু’র এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের ব্যবসার বড় অংশই হয় রোজার ঈদে (ঈদুল ফিতর)। করোনার কারণে এবার রোজার ঈদের ব্যবসায় বড় মন্দা গেছে। কোরবানি ঈদেও (ঈদুল আজহা) ব্যবসা হওয়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। ফলে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকের থেকে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের ব্যবসার চিত্র আরও খারাপ হবে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইর) পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বরাবরই ভালো ব্যবসা করছে এবং বড় লভ্যাংশ দিচ্ছে। তবে শেয়ারবাজারে এসব কোম্পানির সীমিত সংখ্যক শেয়ার থাকার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের তেমন একটা লাভ হয় না।
/এন এইচ