প্রধান শিরোনামশিক্ষা-সাহিত্য
মুম্বাইয়ের জ্ঞানের ঘর
মিঠুন সরকার, মুম্বাই থেকেঃ আজকের গ্রন্থাগার মানেই যেকোন শিক্ষানুরাগীদের ভালবাসার জায়গা। তবে সেই ভালবাসার শেকড় একেবারে গোড়ার মানুষের কাছে। কারণ সে দীর্ঘ চেষ্টায় অব্যয় ধ্বনি থেকে শব্দ তৈরি করলো। সেটা ভাষা তৈরি হলো। তারপর তা সংরক্ষণের দরকার পড়লো। প্রথমে ছবি এঁকে শুরু হলো লেখার প্রচলন। তারও অনেক পরে বর্ণ বা অক্ষর। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ হেঁটেছে এই বিবর্তনের পথে।
যেদিন থেকে মানুষ অক্ষরকে পাথর, চামড়া বা পাতায় আটকে ফেলতে শিখল, সেদিনই তারা সেগুলো সংরক্ষণ করতে চাইলো। করলোও,জন্ম হলো গ্রন্থাগারের। তবে সেটা সংরক্ষণাগার না গ্রন্থাগার এনিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ তখনো বই এর জন্ম হয়নি।এমনকী কাগজের আবিস্কারও হয়নি।সেসময়ের রাজারা ছিলেন এসব সংরক্ষণাগারের পৃষ্ঠপোষক। এগুলো ছিল তখনকার সংস্কৃতি এবং জ্ঞান চর্চা কেন্দ্র। পরে এই গ্রন্থাগার থেকে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাই আমরা প্রাচীন গ্রন্থাগারগুলোকে সভ্যতা বিকাশ কেন্দ্র বলে থাকি। আধুনিক সময়ে শুধু পড়ার জন্যে সৃষ্টি হয়েছে পাঠাগার বা লাইব্রেরি। সেই প্রচীন সভ্যতার রেশ ধরে আজকের দিনেও সমাজ নির্মাণে পাঠাগারের ভূমিকা কম নয়। যেকারণে বই বা পাঠাগারের প্রতি আমার ভালবাসা অগাধ। এই কথাটি বলতে গিয়ে মূলত এত কথা বললাম। ছোটবেলা থেকে এই ভালবাসা সৃষ্টির পেছনে আমার পরিবারের উৎসাহও কম নয়।
তবে একথা বলতে বাঁধা নেই যে ভালবাসা যত বেশি তত বেশি বই পড়া আসলে হয়না।কিন্তু নতুন কোন জায়গায় গেলে প্রথমেই খুঁজি সেখানে কোন গ্রন্থাগার আছে কী না। সপ্তাহ খানেক আগে এসেছি ভারতে। স্বভাবের কারণে পাঠাগারের খোঁজ নিলাম। সন্ধান পেলাম মুম্বাই ভক্তিবেদান্ত গ্রন্থাগারের। এর ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা জেনে মন খুব টানলো। ঠিক করে ফেললাম যেতেই হবে। তারিখ ঠিক করলাম মনে মনে।
২৬শে জানুয়ারি কলকাতা দমদম এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে সোজা মুব্বাই এয়ারপোর্টে। তারপর ট্রেনে মুম্বাইয়ের জুহু ভক্তিবেদান্ত লাইব্রেরি। সব মিলিয়ে সময়ের জার্নি। গিয়ে দেখলাম ধুন্দুমার কাণ্ড। নানা ভাষার বইয়ের নান্দনিক পরিবেশন। লাইব্রেরিতে বাংলা ভাষার পারমার্থিক বইয়ের কর্ণারও রয়েছে। চারপাশে বেশিরভাগই হিন্দি ভাষার মানুষ। আছে বহু দেশি বিদেশি অতিথি।
হিন্দি, তামিল, ইংরেজিসহ ১০ টি ভাষায় সনাতন সংস্কৃতির বই রয়েছে। গ্রন্থগুলো আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা এ সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ও তার শিষ্যরা বৈদিক শাস্ত্রের আলোকে লিখেছেন। পাঠকরা জানালেন, গ্রন্থাগারটি এরই মধ্যে গোটা ভারতের প্রসিদ্ধ পাঠাগার হিসাবে পরিচিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ ইসকনের জুহু মন্দির কর্তৃপক্ষ পাঠাগারটি পরিচালনা করছে।
আমেরিকা,ব্রিটেন, বেলজিয়াম, কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে পাঠক এবং সংগ্রাহকরা ভিড় করেন। ভেতরে বসে পড়ার জন্য রয়েছে বিশাল জায়গা।
পরিচালকরা বলছেন, এটি শুধু গ্রন্তাগারাই নয় বইএর সংরক্ষণাগারও। বিশাল বিশাল সব আলমারিতে পৃথিবীর নানা প্রান্তের দুর্লভ বই সংরক্ষণ করা রয়েছে। কানাডার থেকে আসা তামারা আরনল্ড সাথে কথা হলো। তিনি বললেন এই জাতীয় পাঠাগার না থাকলে সভ্যতা এগোতো না। আদি থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত মানব সভ্যতার উৎকর্ষের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে পাঠাগার। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে জুহু ভক্তিবেদান্ত লাইব্রেরি। মনে মনে এর জয় চেয়ে সেদিন সন্ধ্যায় ছেড়েছিলাম এই জ্ঞান চত্বর।
লেখকঃ স্টাফ রিপোর্টার, সংবাদ প্রতিদিন।