প্রধান শিরোনামব্যাংক-বীমাশিল্প-বানিজ্য
বাংলাদেশের দশটি ব্যাংকের অবস্থা খারাপ
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ দেশে সরকারি-বেসরকারি ১০ ব্যাংকের অবস্থা তুলনামূলক খারাপ। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিচারে এই ১০ ব্যাংককে ‘প্রান্তিক’ মানে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটির পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ।
দেশের ৫৭টি ব্যাংকের ৩০ জুন, ২০১৯ ভিত্তিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং থেকে এ তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১০টি ব্যাংক প্রান্তিক অবস্থায় রয়েছে। আর ৯টি ব্যাংকের অবস্থা ‘মোটামুটি ভালো’। বাকি ৩৮টি ব্যাংকের অবস্থা ‘সন্তোষজনক’। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিচারে দেশে ‘শক্তিশালী’ মানের কোনো ব্যাংক নেই। আবার একেবারেই ‘অসন্তোষজনক’ ক্যাটাগরিতে কোনো ব্যাংক পড়েনি।
ক্যামেলস রেটিং হচ্ছে ব্যাংকের সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিমাপের মানদণ্ড। ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততা, সম্পদের মান, ব্যবস্থাপনা, উপার্জন ক্ষমতা, তারল্য প্রবাহ, বাজার ঝুঁকির প্রতি সংবেদনশীলতা- ৬টি সূচকের অবস্থার ভিত্তিতে এই রেটিং নির্ধারিত হয়।
সূচকগুলোর ইংরেজি প্রতিশব্দের আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত ‘ক্যামেলস’ শব্দটি গঠিত। এই রেটিংয়ে ৫টি ভাগ করা হয়। রেটিং ১ বা ‘শক্তিশালী’ ভালো মান। রেটিং-২ এর অর্থ সন্তোষজনক। রেটিং-৩ পাওয়া ব্যাংককে মোটামুটি ভালো বলা হয়। রেটিং-৪ প্রাপ্ত ব্যাংককে বলা হয় প্রান্তিক মানের। অর্থাৎ এগুলোর অবস্থা ভালো নয়। আর সবচেয়ে খারাপ রেটিং হচ্ছে ৫, যাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে ‘অসন্তোষজনক’।
প্রান্তিক মানে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৫টি রাষ্ট্রীয় মালিকানার। এগুলো হলো- সোনালী, জনতা, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে এবি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান রয়েছে প্রান্তিক তালিকায়।
ক্যামেলস রেটিং নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েকটি ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে পরিস্থিতির বেশি অবনতি হয়েছে। এদের তারল্য পরিস্থিতি এতই খারাপ যে, বড় কয়েকজন গ্রাহক আমানতের টাকা ফেরত চাইলে দেওয়ার মতো সক্ষমতা নেই। বড় অংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে এদের। দীর্ঘদিন ধরে মুনাফা করতে পারছে না। ব্যবস্থাপনা মান মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে রেটিংয়ে কোনো ব্যাংককে ৫ বা অসন্তোষজনক পর্যায়ে রাখে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে থাকে। প্রান্তিক মানের কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ক্যামেলস রেটিং নিয়ে কেউ মন্তব্য করতে চাননি।
মোটামুটি ভালো মান বা ক্যামেলস রেটিং-৩ প্রাপ্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।
আর সন্তোষজনক মান বা ক্যামেলস রেটিং-২ পেয়েছে দেশের বেসরকারি ৩০ ব্যাংক ও বিদেশি ৮ ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে পূবালী, শাহ্জালাল ইসলামী, উত্তরা, দি সিটি ব্যাংক, আইএফআইসি, ইউসিবি, ইষ্টার্ণ, এনসিসি, প্রাইম, সাউথইস্ট, ঢাকা, ডাচ্-বাংলা, মার্কেন্টাইল, ওয়ান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, প্রিমিয়ার, ব্যাংক এশিয়া, ট্রাস্ট, যমুনা, ব্র্যাক, এনআরবি কমার্শিয়াল, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স, মিডল্যান্ড, ইউনিয়ন, মধুমতি, সীমান্ত, ইসলামী, আল-আরাফাহ ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক আল ফালাহ, সিটিব্যাংক এনএ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, হাবিব ব্যাংক, এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও উরি ব্যাংক।
মতামত জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘প্রান্তিক’ মানে থাকার অন্যতম কারণ সুশাসন ও শৃঙ্খলার অভাব। এ ছাড়া দুর্নীতি তো আছেই। তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলো সরকারের কিছু নীতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন বা রাজনৈতিক কারণে এসব ব্যাংকের ওপর কিছু কাজ চাপিয়ে দেয়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালনা করা হয় না। এতে ব্যাংকগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে। এ ক্ষতির দায় সরকারকেই নিতে হবে। আর সরকারি ব্যাংকের দুর্নীতি বন্ধ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারি ব্যাংক থেকে অনিয়ম করে টাকা নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান এমনভাবে নিজেদের গড়ে তুলছে, যেখানে পরে বেসরকারি ব্যাংকও অর্থায়ন করে বিপদে পড়ছে। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও কঠোর হওয়া উচিত। তাদের মূলধন সংরক্ষণ, লোকসান কমানো, নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঠিকমতো রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এই অর্থনীতিবিদের। তিনি বলেন, রেটিং নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কোনো ব্যাংকের আলোচনার তেমন সুযোগ নেই। একটি ব্যাংক রেটিংয়ে ২ পেয়েছে; কেন ১ পায়নি- তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অনেক ব্যাংক একই ধরনের রেটিং পাচ্ছে। তাহলে কি সবই একই মানের? এ বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনা থাকা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
গত জুন শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর সিংহভাগ অর্থাৎ ৯৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা মন্দ বা ক্ষতিজনিত খেলাপি ঋণ। যার অর্ধেকের বেশি বা ৪৯ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে মন্দ বা ক্ষতিজনক ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। প্রান্তিক মানের ব্যাংকগুলোতেই খেলাপি ঋণের হার বেশি। বিতরণ করা ঋণের অনুপাতে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। এই ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৯৭ দশমিক ৬৪ শতাংশই খেলাপি। এর পরই রয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক (সাবেক ওরিয়েন্টাল ব্যাংক)। এই ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ৮২ দশমিক ৬৪ শতাংশই খেলাপি। আর ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে বাধ্য হয়ে নাম পরিবর্তন করে পুনর্গঠিত বেসরকারি খাতের পদ্মা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ৬৬ শতাংশ খেলাপি। ঋণ অনিয়মে সবচেয়ে আলোচিত সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ৬০ দশমিক ৫০ শতাংশ এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। জনতা ব্যাংকের ৪২ দশমিক ৯৬ শতাংশ, সোনালী ব্যাংকের ২৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ, এবি ব্যাংকের ২৮ দশমিক ১১ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৪৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ, রাকাবের ২০ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং কৃষি ব্যাংকের ১৭ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে। খেলাপি ঋণের মাধ্যমে সম্পদের মান বিচার করা হয়ে থাকে।
গত জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৮৭৪ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি এক হাজার ২০১ কোটি টাকা আর বেসিকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৬০০ কোটি টাকা। কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৯ হাজার ১৬৩ কোটি এবং রাকাবের ছিল ৬৮২ কোটি টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের মূলধন ঘাটতি ৩৭ কোটি টাকা। এবি ব্যাংকের ৪২২ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৬৯২ কোটি ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এক হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি ছিল। প্রান্তিক পর্যায়ের রেটিংয়ের ব্যাংকগুলো ঠিকমতো প্রভিশনও রাখতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি এক হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। ৪ হাজার ৭৩ কোটি টাকা ঘাটতি বেসিক ব্যাংকের। এবি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৩ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা ও কমার্স ব্যাংকের ৫১১ কোটি টাকা। প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা বাকি ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি নেই।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, মূলধন ঘাটতির কারণে ক্যামেলস রেটিং অনেক নিচে নেমে যায়। সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ব্যাংকই একমাত্র দায়ী নয়। কারণ সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করে তাদের টাকা আটকে আছে। আবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও পেনশন বাবদ আগাম পরিশোধ করেও শ’ শ’ কোটি টাকা আটকে থাকছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে আমদানি করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছে না এসব ব্যাংক। এসব কারণে তাদের লোকসান হচ্ছে। অন্যদিকে কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার অভাবে ক্যামেলস রেটিংয়ে কম নম্বর পাচ্ছে। বিশেষ করে মানি লন্ডারিং বিষয়ে যথাযথ নম্বর পাচ্ছে না। এসব কারণে সরকারি ব্যাংকগুলোর রেটিং নিম্নমানের। তবে এক্ষেত্রে উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। আর অর্থনীতিতে সরকারি ব্যাংকের অবদান বিবেচনায় নিয়ে রেটিং করলে তাদের মান উন্নত হবে।
/আরএম