সাক্ষাৎকার
মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুজ্জামান এখন সাভারে জনপ্রিয় শেফ
রিফাত মেহেদী, বিশেষ প্রতিনিধিঃ উত্তাল ঢেউয়ের নীল জলে ঘুরে বেড়িয়েছেন সাগর-মহাসাগর। দেশ-বিদেশের কত ভালো-মন্দের অজানা খবর যে পকেটে জমা, তার ইয়ত্তা নেই। জীবন-মৃত্যু সন্ধিক্ষণে কতবার যে দাড়িয়েছেন, হয়তো মনেও নেই। সেই সাহসী মানুষটি কেমন করে বদলে গেলেন। কি ছিলো তার পিছনের গল্প। সোনার হরিণের মতো চাকরি, আর লোভনীয় জীবন-যাত্রা ছেড়ে নিজেকে তৈরি করেছেন শেফ হিসেবে। খারাপ নেই, পেশার পরিবর্তন হলেও ভালো থাকার গল্পই তৈরি করেছেন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। ২০১০ সালে সাভারে যাত্রা শুরু করে ভোজনবিলাসীদের পছন্দের রেস্টুরেন্ট ক্যাফে মেট্রো। অল্প দিনেই খ্যাতি ছড়িয়ে পরে সাভারবাসীদের মাঝে। ধীরে ধীরে ব্যবসার প্রসার বাড়িয়ে সাভারে এখন ক্যাফে মেট্রোর তিনটি শাখা।
মেরিন ইঞ্জিনিয়ার থেকে শেফ আশরাফুজ্জামান
মেরিন ইঞ্জিনিয়ার থেকে শেফ হয়ে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় সফলতার শিখরে পৌছে যাওয়া ব্যক্তিত্ব আশরাফুজ্জামান। বিদেশে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশে রন্ধনশিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার পেছনের গল্প বলছিলেন নিজের মুখেই।
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামের মরহুম হযরত আলী সরকারের ছেলে আশরাফুজ্জামান ছিলেন পুরোদস্তুর মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। নারায়ণগঞ্জ মেরিন টেকনোলজি ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা শেষে লাইটার জাহাজে যোগ দেন শিক্ষানবিশ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে প্রতিষ্ঠানের মাদার ভ্যাসেল ডুবে যায়। তবে নিজের জীবন রক্ষা পেলেও প্রকৃতির ভয়াল সেই তাণ্ডব প্রভাব ফেলে তার জীবনে। চলে যান সিঙ্গাপুরে। জাহাজ ছেড়ে কাজ নেন ক্যাপেল শিপ ইয়ার্ডে। পরে সেখান থেকে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন ইন্টিগ্রডেড টেকনিক নামের ভিন্ন আরেকটি প্রতিষ্ঠানে।
চাকরির সুবাদে দেশে-বিদেশে ঘোরার সুযোগ পান আশরাফুজ্জামান। শখের বশেই ঘুরতে ২০০১ সালে যান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। সেখানে শিপইয়ার্ডে কোনো কাজ না পেয়ে ডেলিভারিম্যান হিসেবে ঘণ্টায় মাত্র ৪ ডলার বেতনে কাজ নেন । গাই অ্যান্ড গেলার্ড নামের একটি চেইন ফাস্টফুডের দোকানে। সেখান থেকেই শুরু। সংস্পর্শে আসতে থাকেন রান্নার সাথে। বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট এ কাজ করতে করতে আয়ত্বে আসে রান্নার বিভিন্ন প্রক্রিয়া।
দেশে এসে চাকরি করতে আর ভালো লাগেনি। রন্ধনশৈলীকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা থেকে প্রতিষ্ঠা করেন ক্যাফে মেট্রো।
ক্যাফে মেট্রোর সুখ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার গোপন রহস্য হল জনাব আশরাফের হাসিমাখা মুখ এবং প্রবল আন্তরিকতা। কাস্টমারের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টির জন্য দিনরাত খেটে চলা এই মানুষটি বলেন, খাবারের গুণগত মান ও নিজেদের আন্তরিকতা রেললাইনের মত। রেললাইনের যদি একপাশ ভালো থাকে আরেকপাশ অকেজো থাকে তাহলে রেলগাড়ি চলতে পারেনা। আমার ব্যবসায় কোয়ালিটি এবং আন্তরিকতা হল এক অন্যের পরিপূরক, ঠিক রেললাইনের মত।
সাভারের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব আশরাফুজ্জামানের ক্যাফে মেট্রো পরিবার
সাভারের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব এখন আশরাফুজ্জামান। খাবারের প্রশংসা করে অধিকাংশ ভোজনরসিক তার সাথে একটি সেলফি তুলে শেয়ার করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিভিন্ন ফুড ব্লগার গ্রুপগুলোতে তার জনপ্রিয়তা ও মানের জয়জয়কার এখন নজরকাড়া। জনপ্রিয়তাকে কেমন ভাবে উপভোগ করেন জানতে চাইলে বলেন, আমার খুব ভালো লাগে যখন সবাই আমার খাবারের প্রশংসা করে আমার সাথে ছবি তুলতে আসেন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কাস্টমার তো থাকেই। তারপরেও রেগুলার কাস্টমারদের দেখলে খুব ভালো লাগে। যারা প্রতিনিয়ত আসে তাদের অনেকেরই পরিবারের সাথেও আন্তরিকতা গড়ে উঠেছে। সাভারে এখন ৫-৭ হাজার মানুষের পরিবার আমার। তাই-ই মনে হয় সবসময়। তাদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করি। এতে অনেক আনন্দ পাই।
উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতা
ক্যাফে মেট্রোতে এখন ৪৫ জন মানুষের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। তাদের সকলের বেতন ভাতা পরিশোধ করে নিজের মত কিছু আয় করতে পারছি। আমি নিজে চাকরি করে যে টাকা বেতন পেতাম না তার চেয়েও বেশি টাকা আমি নিজে বেতন দিচ্ছি এটা ভাবলেই খুব শান্তি লাগে। আনন্দ পাই উদ্যোক্তা হিসেবে।
সম্প্রতি সময়ে গড়ে প্রতিদিন ফুডপান্ডার মাধ্যমে ক্যাফে মেট্রোতে অর্ডার আসে ১৮০ থেকে ২০০ এর মত। তার মানে ঘরে কিংবা অফিসে বসে এতগুলো অর্ডার দিচ্ছেন ক্যাফে মেট্রো পরিবারের সদস্যরা। আর তিনটি শাখায় ইন-হাউজ আরও অর্ডার তো আছেই। সব অর্ডার সার্ভ করতে গিয়ে সামান্য ভুল ত্রুটি ঘটেই যায়। আশরাফুজ্জামানের ভাষ্যমতে, কেউ কোন অভিযোগ জানিয়ে সুফল পাননি এমন কখনো ঘটেনি। আমি চাই আমার কাস্টমার যেন আমার উপর কখনো অভিমান করার সুযোগ না পায়।
সাভারের বড় বড় আয়োজনের কেক কিংবা ক্যাটারিং সার্ভিসের অর্ডার এখন ক্যাফে মেট্রোর দখলে এটাই আমার গর্বের বিষয়, যোগ করেন তিনি।
শুধুমাত্র কফি দিয়ে যাত্রা শুরু করা এ ক্যাফে মেট্রো এখন সফলতার সাথে নিজেদের তুলে ধরেছে ফাস্টফুড আইটেম, কেক, চকলেট, বাংলা, ইন্ডিয়ান, চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল খাবারের বেশ কিছু ধরণের।
সাভারের থানা রোডে ক্যাফে মেট্রোর দুটি শাখা অবস্থিত। সাভারের ব্যাংক কলোনী এলাকায় ক্যাফে মেট্রো তাদের তৃতীয় শাখা পরিচালনা করছে। যেকোন প্রয়োজন বা অর্ডারের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন। মোবাইলঃ ০১৮১৭-৬৯৮০৭৮, ০১৭৮২-২৩৪৩৪০।
/আরএম/জেডএইচ