সাক্ষাৎকার

আত্নহত্যার ভাবনা থেকে ফিরে, বিখ্যাত হ্যারি পটারের লেখিকা

মোঃ রোকনুজ্জামান মনি, নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘জীবনের শুরুর ৩৫ বছরে নেই কোনো আনন্দের সংবাদ। এসময়ে কখনো প্রাণ খুলে হাসা হয়েছে কিনা তাও মনে পড়ছে না।‘-এসব ভাবনা থেকেই আত্নহত্যার চেষ্টারও করেছিলেন তিনি।

বলতে গেলে তার ৫৪ বছরের জীবনে ৩৫ বছরই শুধু প্রত্যাখান, কষ্ট আর বিষাদের স্মৃতিতে ভরা।

বাবা নেই তাতে আবার ২৫ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু, সবকিছু যেন চোখের পলকে তছনছ হয়ে গেল। নিস্বসঙ্গ পৃথিবীতে বেঁচে থাকায় যখন দায় তখনও মায়াময় পৃথিবীতে শুধু টিকে থাকার জন্য একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ। বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে খুঁজতে শুরু করলেন জীবন সঙ্গী। একসময় প্রেম করে বিয়েও করলেন, কিন্তু বিধি বাম। বিয়ে টিকলো না। ২৭ বছর বয়সেই হয়ে গেলো বিবাহ বিচ্ছেদ ।

ভাগ্যের কি পরিহাস এর মধ্যে জন্ম নেয় এক সন্তান। শুরু হয় সিঙ্গেল মাদার হয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। একে অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপ তার উপর আবার সিঙ্গেল মাদার, সব কিছু মিলিয়ে পৃথিবীটা বেশ ছোট হয়ে আসছিল। চাল নেই, চুলো নেই, পেটে ভাত নেই, মাথা গুঁজার ঠাই নেই, সন্তানের চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য নেই ! সবকিছু মিলিয়ে চারিদিকে শুধু হতাশার হাতছানি।

জীবনের সাথে যুদ্ধ করে আর যেন পেরে উঠা যাচ্ছিল না। তাই জীবনের সকল লেনা দেনা চুকিয়ে দিয়ে , জীবনের করাঘাত থেকে মুক্তি পেতে সবশেষে নিতে হলো আত্নহত্যার মত কঠোর সিদ্ধান্ত। কিন্তু মৃত্যু সম্মুখে ভেসে ভেসে উঠলো সন্তানের মায়াভরা মুখ। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আত্নহত্যা থেকে পিছু হটতে হলো ।

তবে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এবার শুরু হলো বেঁচে থাকার নতুন লড়াই । জীবনের ৩৫ তম বছরে এসে নিজের সৃজনশীলতা,আর দৃঢ়তার উপর ভর করে চলতে শুরু করলেন নতুন পথ। টেবিলের উপরে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা ময়লা ডায়েরী হাতে তুলে নিয়ে লিখতে শুরু করলেন অনন্য উদ্দ্যোমে । একসময় লিখে ফেললেন পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় বই হ্যারি পটার। বলছিলাম জনপ্রিয় হ্যারি পটার সিরিজের লেখিকা জে কে রাউলিং এর কথা। যে কিনা এখন ১.৫ বিলিয়নের মালিক। হ্যারি পটার সিরিজের জন্ম হয়েছিল স্কটল্যান্ডের এডিনবরার এক ক্যাফেতে বসে । বহুদিন আগে ম্যানচেস্টার থেকে ট্রেনে লন্ডনে যাওয়ার সময় লেখিকার মাথায় একটি গল্পের চিন্তা এসেছিল—এক ছোট্ট ছেলের কাহিনি, যে ট্রেনে চড়ে জাদুকরদের এক স্কুলে ভর্তি হতে যাচ্ছে। সেই ছেলে আর কেউ নয়, হ্যারি পটার।

১৯৯৫ সালে রাউলিং হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার’স স্টোন বইটি লেখা শেষ করেন আর কয়েকজন এজেন্টকে বইয়ের পাণ্ডুলিপি পাঠান। মজার বিষয় হলো, শুরুতে কোনো প্রকাশক বইটি ছাপতেই রাজি হয়নি। বড় বড় অনেক প্রকাশক পাণ্ডুলিপিটি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। টানা এক বছর ধরে চেষ্টার পর একজন প্রকাশক পাওয়া যায়।

তা-ও সম্ভব হয়েছিল সেই প্রকাশকের আট বছর বয়সী মেয়ের কারণে, যে বইটি দারুণ পছন্দ করেছিল। বইটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অগ্রিম সম্মানী হিসেবে রাউলিংকে দেড় হাজার পাউন্ড দেওয়া হয়। প্রথম প্রকাশে ছাপা হয়েছিল মাত্র এক হাজার কপি, যার মধ্যে ৫০০ কপিই বিক্রি করা হয়েছিল বিভিন্ন স্কুলের লাইব্রেরির কাছে। হ্যারি পটারের প্রথম সংস্করণের সেই বইগুলো আজ পৃথিবীজুড়ে সংগ্রাহকদের কাছে এক অমূল্য, দুষ্প্রাপ্য সম্পদ বলে বিবেচিত হয়, আর প্রতিটি বইয়ের বর্তমান দাম বেশি নয়, মাত্র ২৫ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৩ লাখ টাকা)।

১৯৯৮ সালে ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে রাউলিং তাঁর প্রথম দুটি বইয়ের চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বত্ব বিক্রি করে দেন, এরপর আর কখনো অর্থাভাবে পড়তে হয়নি তাঁকে। হ্যারি পটার সিরিজের বইগুলো একের পর এক সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করে। প্রকাশনা জগতের ইতিহাসে সব রেকর্ড ভেঙে হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য গবলেট অব ফায়ার বইটি প্রকাশ হওয়ার প্রথম দিনেই যুক্তরাজ্যে বিক্রি হয় প্রায় তিন লাখ কপি, আর দুদিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হয় ৩০ লাখ কপিরও বেশি!

সাফল্যের শিখরে উঠলেও নিজের সবচেয়ে কষ্টের দিনগুলোর স্মৃতি ভুলে যাননি রাউলিং। ২০০০ সালে তিনি একটি দাতব্য ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন, যা দুস্থ নারী ও শিশুদের জন্য প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ পাউন্ডের মতো সহায়তা প্রদান করে থাকে।

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close