প্রধান শিরোনামবিনোদন
রঙ্গিন মানুষ, সাদামাটা গ্রামবাসী; পূবাইলে ভালোবাসার ভাদুন গ্রাম
রিফাত মেহেদী, বিশেষ প্রতিনিধি: দেশের নাটক সিনেমার যত শুটিং হয় তার অধিকাংশই হয় গাজীপুর জেলার পূবাইলের ভাদুন গ্রাম। এখন সেখানে ১০ থেকে ১২ টি শ্যুটিং বাড়ি আছে। এছাড়া এই গ্রামের মানুষর সাথে জনপ্রিয় থেকে শুরু করে প্রায় সব অভিনেতা-অভিনেত্রীর ভিন্ন একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছে। কোন অভিনেতার কি খাবার পছন্দ সেটাও বলে দিতে পারেন তারা। মূলত অভিনয়ের খাতিরে এতটা আসা-যাওয়া। এখন রঙ্গিন মানুষগুলোর দ্বিতীয় গ্রাম হয়ে উঠেছে এই ‘ভাদুন’।
পূবাইলের শুটিংয়ের ইতিহাস নিয়ে কথা হয় সেখানের স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ বাসেদের সাথে। তিনি ঢাকা অর্থনীতিকে বলেন, একসময়ের চলচ্চিত্রের ক্যামেরাম্যান জাহাঙ্গীর আলম বিয়ে করেন গাজীপুরের পূবাইল এলাকায়। এরপর তাঁর ছবির বেশ কিছু গানের অংশ দৃশ্যায়ন হয় পূবাইলে। এরপর একদিন গুণী নির্মাতা আমজাদ হোসেন আসেন পূবাইলে। তিনিই ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে সর্বপ্রথম প্রায় ২৬ পর্বের ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ করেন । সে হিসেবে পূবাইলে চিত্রায়িত প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘আগুন লাগা সন্ধ্যা’।
তিনি আরও বলেন, আমজাদ সাহেব যখন এই এলাকায় কাজ শুরু করলেন তখন থেকে এলাকার পরিবেশ ও সৌন্দর্যের কথা ছড়িয়ে পড়ে অন্যদের নির্মাতা ও পরিচালকদের মাঝে। অন্যরাও তখন আসতে শুরু করেন এই এলাকায় শুটিং এর জন্য। এভাবেই পূবাইলের ভাদুন গ্রামের জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
একটা সময়, সেখানে ভালো থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা ছিলো না। ফলে শুটিং এ আসা কলাকুশলীদের সহযোগিতায় গ্রামবাসী এগিয়ে আসতেন। রান্না করে খাওয়াতেন পছন্দের খাবার। গাছের তাজা ফল আবার পুকুরের মাছ-এসব দিয়ে প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর খুশি করার চেষ্টা করতেন। শুটিং শেষে অনেকে আবার খুশি হয়ে বখশিশ স্বরুপ দিয়ে যেতেন অল্প কিছু টাকা। এভাবেই সখ্যতা গড়ে উঠে। ধীরে ধীরে ভালেঅবাসার বন্ধনে পরিণত হয়। ফলে তাদের পছন্দ-অপছন্দ অনেকটাই আমরা বুঝি। তবে সময়ের ব্যবধানে কিছুটা পরিবর্তন আসলেও, বন্ধনটা এখনো আছে।
এখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নায়ক-সিনেমার শ্যুটিং এটা যেন খুব মামুলি বিষয়। রাজধানীর অদূরে হওয়ায় নাটক সিনেমার কলাকুশলীদের কাছে পূবাইলের গুরুত্ব অপরিসীম। সুযোগ বুঝে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন পূবাইল থেকে। ছবির মতো সুন্দর গ্রাম ভাদুন। যে কখনো গ্রাম দেখেনি তার কাছে এ জায়গা স্বর্গের একটা ছায়া বলে মনে হবে। যখন ভাদুন এলাকার ভেতর দিয়ে ঢুকবেন তখন হৃদয়ের ভেতর আপনিতেই বাজতে থাকবে রবি ঠাকুরের সেই গান ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ অমায় মন ভুলায়রে… ’।
পূবাইল রেলগেট থেকে হাতের বাঁয়ে ও ডানে যে পথ দুটি চলে গেছে তার পুরোটাই সবুজ-শ্যামলে আচ্ছাদিত। নীরব আঁকা-বাঁকা ডানপাশের পথটিতে বেশ কয়েকটি শুটিংবাড়ি। পথের পাশেই ‘হাসনাহেনা’ শুটিং স্পট। বিশাল জায়গাজুড়ে অত্যন্ত গোছানো ও পরিপাটি একটি রিসোর্ট। যেখানে গেলেই মন জুড়িয়ে যায়। রাস্তা, দুপাশের বাড়িঘর, খেত-খামার—সবই যেন ডুবে আছে সবুজে। এসব পেরিয়ে দেখা মেলে শুটিং বাড়ির। একটি-দুটি নয়, বেশ কয়েকটি।
ঢাকা থেকে তারকারা এখানে এসে নিয়মিত শুটিং করেন। এখানে শুটিং বাড়ির প্রতিদিনের ভাড়া তিন থেকে ছয় হাজার টাকার মধ্যে। একসঙ্গে কয়েক বছরের জন্য ভাড়া নেওয়া যায় বেশির ভাগ বাড়ি। সেক্ষেত্রে ভাড়ার পরিমাণ আরও কমে আসে।
অনেক তারকা ও পরিচালক একনাগাড়ে কয়েকদিন শুটিং শেষ করে তবেই রাজধানীতে ফেরেন। কারণ বেশির ভাগ শুটিং বাড়িতেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। অভিনয়শিল্পীরা শুটিং শেষে প্রায়ই ভাদুন গ্রাম থেকে বিভিন্ন ফলমূল ও শাকসবজি নিয়ে যান।
এই গ্রামের একেকটা বাড়ি হয়ে উঠেছে একেকটা শুটিং স্পট। পূবাইলের বেশির ভাগ শুটিং সমন্বয় ও সহযোগিতা করেন আফতাব উদ্দিন। নিজে অভিনয়ও করেন। পরিচালকরা আসার আগে তাঁকে ফোন করেন। জেনে নেন কোন শুটিং বাড়ি খালি আছে! তিনি জানালেন, পূবাইলে প্রায় ১০-১২টি শুটিং বাড়ি আছে। বাড়ির নিজস্ব নাম ছাপিয়ে কিছু বাড়ি পরিচিত পেয়েছে মালিক বা লিজ নেওয়া ব্যক্তির নামে।
যেমন–মেঘলা শুটিং বাড়িকে ডাকা হয় হালিমের বাড়ি নামে। এ ছাড়া আকাশ ভিলা, বশির ভাইয়ের হাউস, হাসনা হেনা, মনিরের বাড়ি, শাহিনের বাড়ি, গৌধুলী, প্যারাডাইস ও ম্যাডামের বাড়ি নামে পরিচিতি আছে শুটিং বাড়িগুলোর। আছে বিল বিলাই ও চটের আগা নামে দুটি শুটিং করার আলাদা জায়গা। যেকোনো শুটিং বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ই কানে আসে লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন শব্দগুলো। শুধু তাই নয়, পূবাইলের ভাদুন গ্রামের রাস্তা, ক্ষেত, বাড়ির পাশের বাগান, ডোবা, বিল, কাছের রেল স্টেশন সবই যেন শুটিং স্পট।
রাজধানীর উত্তরা বা মিরপুর থেকে আব্দুল্লাহপুর হয়েই আপনি সহজেই যেতে পারবেন পূবাইল রেল গেইট বা পূবাইল কলেজ গেইট। সেখান থেকে ভাদুন গ্রাম খুবই কাছে। সেখানে শুটিং বাড়ি ছাড়াও পেয়ে যাবেন বেশ কিছু মানসম্পন্ন রিসোর্ট।