ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ ৩০০০ বছর ধরে চর্চা করে আসা চীনাদের এক অদ্ভুত আচার ও ঐতিহ্যের মিশেলের নাম ‘ফেংশুই। এই শাস্ত্র নাকি বাসস্থান, আসবাবপত্র, সহ আরও বহু বস্তুর অবস্থানের ওপর নির্ভর করে ঠিক করে দেয় ঠিক কোন অবস্থানের ওপর নির্ভর করছে আপনার পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধি-সাফল্য। একি আদৌ বাস্তব নাকি নিছক বিশ্বাসকে পুঁজি করে সৃষ্ট মিথ। পাঠক তা নিয়েই আজকের লেখাটি।
সভ্যতার আদিতে সুসভ্য জাতি হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেছিলো চীনারাই। তারাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে কাগজ, চা, সিল্ক এমন কি আফিমের সাথে। সেই চীনারাই প্রবল ভাবে বিশ্বাস করে যে বাস্তু শাস্ত্রে যার নাম ‘ফেংশুই।’ চীনাদের ভাষ্য মতে ফেংশুই প্রাচীন শিল্প এবং বিজ্ঞান এর সমন্বয়। আক্ষরিক অনুবাদে ফেং শব্দের অর্থ “বায়ু” এবং শুই শব্দের অর্থ “পানি”। চীনা সংস্কৃতিতে, বায়ু ও পানি ভাল স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত। আবার ফেংশুই বলে দুই ধরণের। ভালো ফেংশুই সৌভাগ্যের নির্দেশক। বিপরীতে, খারাপ ফেংশুই অর্থ দুর্ভাগ্যের নৈকট্য ও দুর্ভোগ।
ফেংশুই সংশ্লিষ্ট কিছু উপাদান নিয়ে কমপক্ষে ৬০০০ বছর পূর্ব হতে অনুশীলন রত রয়েছেন এর সঙ্গে জড়িত সাধকরা। তাদের মতানুসারে ফেংশুইতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উপাদান। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পদার্থ ও ভৌত বিজ্ঞান, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্র প্রভৃতি। এটি তাওবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মিলে যায় এবং প্রকৃতিবাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা নির্দেশ করে। এই মতবাদে বিশ্বাস করা হয় ভূমি জীবিত এবং চি বা শক্তি দিয়ে ঘেরা। আরও একটি বিশ্বাস হলো পৃথিবীতে বিপরীত মুখী দুইটি শক্তি বিদ্যমান যার একটি হচ্ছে YIN ও অপরটি YANG। পাঁচটি বস্তুর সহায়তায় এই শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব। সেই বস্তু বা উপাদানগুলো যথাক্রমে কাঠ, অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু ও পানি। কোনও জায়গায় ফেংশুইয়ের বিশ্লেষণে ব্যবহৃত প্রধান সরঞ্জামগুলি হল ফেংশুই কম্পাস এবং ব্যাগুয়া।
ফেংশুই সংক্রান্ত কিছু বিশ্বাস:-
বাসার প্রবেশ দ্বার লাল হওয়া সৌভাগ্যের প্রতীক: ফেংশুইতে কি সত্যিই বলা হয়েছে লাল রঙের প্রবেশ দ্বার সৌভাগ্য বয়ে আনে? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, কিন্তু তা প্রত্যেক ঘরবাড়ির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় ! ফেংশুই অনুসারে রঙের সফল ব্যবহার সুনির্দিষ্ট কিছু কারণের উপর নির্ভর করে। আর তার মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে দিক অনুসারে আপনার আবাস স্থলের অবস্থান। এটি কি পূর্বমুখী না পশ্চিম মুখী, উত্তর না দক্ষিন এসব পরখ করেই ফেংসুই অনুসারে প্রবেশ দ্বারের রঙ নির্ধারিত হয়।
সৌভাগ্যের প্রতীক বাঁশ ঝাড় ও ঝর্না: একটি ছোট বাঁশ গাছ এবং বাসায় অবস্থিত ছোট কৃত্রিম ফোয়ারা বা ঝর্ণা- এই ধরণের উপকরণগুলি প্রায়শই ফেংশুইয়ের সাথে সম্পর্কিত। উভয় উপকরণই একটি বাড়ী বা অফিসের সমৃদ্ধি অর্জনের হাতিয়ার ও দূর্ভাগ্য তাড়ানোর জন্য কার্যকর ফেংশুই চিকিত্সা হিসাবে জনপ্রিয়। যাইহোক, আপনার বাড়িতে তাদের অনুপস্থিতি (বা উপস্থিতি) ভালো বা খারাপ ফেংশুই এর নির্ধারক হতে পারে না। তবে সভগ্য যদি মাত্রও দুইটি উপকরণ বয়ে আনে তাহলে ক্ষতি কি!
ফুল শয়ন কক্ষের জন্য খারাপ ফেংশুই: যদিও এটি মানতে আমার বেশ কষ্ট হয়েছে। তবে ফেংশুই অনুসারে টাটকা ফুলের একটি সূক্ষ্ম শক্তি আছে (chi) যা যে কোন স্থানএ মিস্তি সুগন্ধ ছড়ায়। কিভাবে আপনার শয়নকক্ষের জন্য ফুল খারাপ ফেংশুই হতে পারে? ফেংশুইয়ের মতানুসারে সব উপকরণ- ই আপনাকে নির্দিষ্ট সেবা দেয় তবে তাদের প্রভাব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হলে সাধারণ আবেগের বশবর্তী হওয়া চলবে না। বস্তুর বিশ্লেষন করতে হবে তাজা ফুলের একটি ছোট বুকে বেডরুমের জন্য ভালো প্রভাবক হলেও ফেনশুই অনুসারে, বিশাল রঙিন ফুল গুচ্ছ শয়ন কক্ষে বিরূপ প্রভাব ছড়ায়।
আপনার আসবাবপত্র সরান, আপনার জীবন পরিবর্তন করুন: আপনার সোফা সরালে এবং অবিলম্বে জানলেন আপনার প্রোমোশন হয়েছে? কেমন হবে ব্যপারটি। আমার কিন্তু বিশ্বাস করতে বাধছে। সময় সময় আসবাবের অবস্থান পরিবর্তন ঘরের সাথে বলে জীবনেও আনতে পারে নতুনত্ব ও সুসংবাদ। ফেংশুই এর মতে প্রথম অবস্থায় তা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও রীতি মেনে চলে হতে পারে তা সারাজীবনের জন্য টেকশই। পেতে পারেন কাঙ্খিত সহধর্মিণী সহ বহু কিছু।
যদি আপনার বিছানা সৌভাগ্যের দিকে না হয় তাহলে সর্বনাশ: সঠিক বলতে পারছি না আপনার সৌভাগ্য নির্দেশক দিক কোনটি? সত্যি বলতে নিজেরটাও জানি না। তবে ফেংশুই বলে নির্ধারণ করতে জানে ব্যক্তি ভেদে সৌভাগ্যের দিক। আর সেদিকে যদি আপনা বিছানা থাকে তবে সাফল্যের বর্ষণে আপনি ধনী নতুবা দুর্ভাগা। আবারো আমার মানতে বাঁধছে, পাঠক আপনি কিভাবে নিবেন এই মতামতকে?
সঠিক বৃক্ষের প্রতিস্থাপন বয়ে আনবে সৌভাগ্য সঙ্গে ধন রাশি: বৃক্ষ সকল সুখের আঁধার। ফেংশুই বলে বৃক্ষের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পৃথিবীর শক্তি বা Chi, সুস্বাদু, সুষম উদ্ভিদ প্রকৃতির প্রতিলিপি তৈরি করে, আর তার তার সাহচর্যে আপনার দেহ মনে ছড়িয়ে পড়ে পজিটিভ এনার্জি। আপনারা মানি প্ল্যান্ট দেখেই থাকবেন। সৌন্দর্য বর্ধনে আপনি নানা ধরণের মানিপ্ল্যান্ট এমনিতে আপনার বাসস্থান ও অফিস স্পেসে সাজিয়ে রাখেন। ফেংশুই অনুসারে নানা ধরণের মানিপ্ল্যান্ট ও তার স্পন্দন ডেকে অানে প্রাচুর্য। তাহলে পাঠক আমরা নিজের অজান্তেই মানিপ্ল্যান্ট দিয়ে ঘর সাজিয়ে সাফল্য ও প্রাচুর্যের অতি নিকট রয়েছি। শুধুমাত্র জানা প্রয়োজন আমার বা আপনার জন্য ফেংশুই অনুসারে সঠিক মানিপ্ল্যান্ট কোনটি।
চুলোর সঠিক অবস্থান রান্নাঘর ও পারিবারিক স্বাস্থ্য রক্ষার উৎস: আপনি যদি রান্না করা, বিনোদন বা খাওয়া পছন্দ করেন, তবে জেনে রাখুন ফেংশুই অনুসারে আকর্ষণীয় রান্নাঘর ও স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ সৃষ্টির নানা রীতি রয়েছে। যদিও ফেংসুই অনুসারে পজিটিভনেসের জন্য চুলার অবস্থান জরুরী, তবে রান্নাঘর কে রুচিশীল ও পরিপাটি রাখতে, নিজেদের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাই কি যথেষ্ট নয় ? সব বিষয়ে ফেংশুই মানা বাড়াবাড়িও তো হতে পারে।
মান্দারিন ডাক (চীনা হাঁস) চিরস্থায়ী প্রেম বয়ে আনে: মান্দারিনের হাঁস প্রেমের জন্য সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং প্রাচীন বাস্তু শাস্ত্র ফেংশুই অনুসারে মান্দারিন হাঁস আপনার জীবনে অনুগত, প্রেমময় জীবন সঙ্গিনী ডেকে আনে। ভালোবাসায় যাবতীয় সমস্যার সমাধান এই মান্দারীন হাঁস। তো প্রেমিক প্রবরগণ যদি আপনার ফ্রেন্ড লিস্টে থাকে কোন চীনা বন্ধু আজই অনুরোধ করুন তাকে আপনার জন্য এক জোড়া মান্দারিন হাঁস যোগাড় করে দিতে। নিজেই পরখ করুন ফেংশুই এর সত্যতা।
সয়ন কক্ষে ঘড়ি প্রদর্শন খারাপ ফেংশুই: ঘড়ি সময় বয়ে চলার নির্দেশিকা। সময়কে তো আর বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। আপনি যদি প্রতিটি কাজ ঘরির কাঁটা মেপে করেন তবে মনে রাখুন; ফেংশুই আপনাকে বলছে ঘড়ির সতর্ক ব্যবহার করতে। শয়ন কক্ষে ঘড়ির ব্যবহার খারাপ ফেংশুই। আপনি বাস্থানের যে কোন জায়গায় দেয়াল ঘড়ি ঝুলান কিন্তু সয়ন কক্ষে নয় ( প্রাচীন ফেংশুই মত)।
ব্যগুয়া আয়না আপনার আবাসস্থল কে রাখবে সুরক্ষিত: অনেকেই ব্যাগুয়া মিরর শো পিস হিসেবে ঘরের অভ্যন্তরে সাজিয়ে রাখে। ফেংশুই শাস্ত্র অনুসারে ঘরের অভ্যন্তরে কখনোই ব্যগুয়া মিরর রাখা উচিৎ নয়। এটি ঘরের বাহিরে মূল দরজায় ঝুলিয়ে রাখা উচিৎ। Sha Chi বা অশুভ শক্তির আক্রমণ হতে আপনার আবাসস্থল কে রক্ষা করে ব্যাগুয়া মিরর। হুম তাহলে যে কোন অপশক্তি, অমঙ্গল হতে রক্ষার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নেই রয়েছে ব্যাগুয়া মিররের হাতে ! আমি এই সূত্রে নির্বাক ও ভাষাহীন। পাঠক বিবেচ্য আপনার।
এই লেখায় চীনা বাস্তু শাস্ত্র “ফেংশুই” সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। যদিও বাস্তু শাস্ত্র বিশ্বাসের প্রশ্ন। কত কিছুই তো রয়েছে আমাদের জ্ঞানের সীমারেখার বাইরে। তবু প্রশ্ন থেকেই যায় যে আধুনিক জনগণ ‘ফেংশুই’ এর রীতিনীতি আদৌ মানতে পারবে কি?
/এন এইচ