দেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
হাজিদের ইহরাম বাঁধার নিয়ম-পদ্ধতি
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: শ্বেত-শুভ্র দুই জোড়া কাপড়। সফেদ-চাঁদির মতো দ্যুতি ছড়ায়। হাজিদের ও ওমরাহ পালনকারীদের এই দুইটি কাপড়কে ইহরাম বলে। হজ-ওমরাহর জন্য ইহরাম বাঁধা ফরজ। ইহরাম ছাড়া হজ-ওমরাহ আদায় হয় না।
ইহরাম বাঁধা ফরজ
হজ ও ওমরা পালনের নিয়তে যারা মক্কার উদ্দেশে গমন করেন, তাদের মিকাত (নির্ধারিত স্থান) অতিক্রম করার আগে ইহরামের কাপড় পরে নিতে হয়। ইহরাম না পরে মিকাত অতিক্রম করা তাদের জন্য জায়েজ নয়। সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন দিক থেকে আগত হজযাত্রীদের জন্য পাঁচটি নির্দিষ্ট স্থানকে শরিয়ত ‘মিকাত’ হিসেবে নির্ধারণ করেছে।
ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান
ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থানকে শরিয়তের ভাষায় মিকাত বলা হয়। পাঁচটি স্থান থেকে ইহরাম বাঁধা যায়।
এক. জুল হুলায়ফা বা বীরে আলী: এটি মদিনাবাসী এবং মদিনা হয়ে মক্কায় প্রবেশকারীদের মিকাত।
দুই. ইয়ালামলাম: এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে জেদ্দা হয়ে মক্কা প্রবেশকারীদের মিকাত।
তিন. আল-জুহফা: এটি সিরিয়া, মিসর ও সেদিক থেকে আগতদের মিকাত।
চার. কারনুল মানাজিল বা আসসায়েল আল-কাবির: এটি নাজদ থেকে আগতদের জন্য মিকাত।
পাঁচ. যাতুল ইরক: এটি ইরাক থেকে আগতদের জন্য মিকাত।
ইহরাম বেঁধে ‘তালবিয়া’ পাঠ
ইহরামের নিয়ম হলো, মিকাত থেকে তালবিয়া পড়ার মাধ্যমে হজের নিয়ত করা। পুরুষরা ইহরামের সময় সেলাই করা কাপড় খুলে সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করবে। (বুখারি, হাদিস নং: ১৭০৭)
ইহরামের মূল বিষয় হচ্ছে হজ বা ওমরাহর নিয়তে তালবিয়া পাঠ। এর মাধ্যমে ইহরাম সম্পন্ন হয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে মাথায় সিঁথি করা অবস্থায় ইহরামের তালবিয়া পাঠ করতে দেখেছি। তিনি বলেছেন, এই বাক্যগুলোর অতিরিক্ত কিছু বলেননি।’ (মুসলিম, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩৭৬)
তবে ইহরামের সুন্নত হলো- মোচ, নখ ও শরীরের পরিষ্কারযোগ্য লোম মুণ্ডাবে বা কেটে পরিষ্কার করবে। উত্তমরূপে গোসল করবে; গোসল সম্ভব না হলে ওজু করবে। পুরুষগণ দু’টি নতুন বা ধৌত সাদা চাদর নিবে। একটি লুঙ্গির মতো করে পরবে। অপরটি চাদর হিসাবে ব্যবহার করবে। পায়ের পাতার উপরের অংশ খোলা থাকে এমন জুতা বা স্যাণ্ডেল পরবে। নারীরা স্বাভাবিক কাপড় পরবে। তাদের জন্য ইহরাম অবস্থায় জুতা-মোজা পরার অবকাশ রয়েছে।
ইহরাম বাঁধার আগে সুগন্ধি ব্যবহার
ইহরাম বাঁধার আগে খালি শরীরে আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা মুস্তাহাব। শরীরের আতর বা ঘ্রাণ ইহরাম গ্রহণের পর বাকি থাকলেও অসুবিধা নেই। তবে ইহরামের কাপড়ে আতর বা সুগন্ধি লাগাবে না। কেননা ইহরামের কাপড়ে এমন আতর বা সুগন্ধি লাগানো নিষেধ, যার ঘ্রাণ ইহরামের পরও বাকি থাকে। মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে ইহরাম বাঁধার আগে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বে। অতঃপর যে হজ আদায়ের ইচ্ছা সে অনুযায়ী নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করবে।
গোঁফ-নখ এবং ‘গুপ্তস্থানে’র লোম পরিষ্কার
যে ব্যক্তি হজে যেতে চায় তার শরীরের ক্ষৌর কার্য সম্পর্কে বিখ্যাত তাবেয়ি হজরত আতা (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘এর অনুমতি আছে, এতে কোনো অসুবিধা নেই।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৪৯৯৮)
ইহরামের উদ্দেশ্যে উত্তমভাবে গোসল করা
জায়েদ বিন ছাবেত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (সা.)-কে ইহরামের জন্য পরিহিত পোশাক খুলতে এবং গোসল করতে দেখেছেন। (তিরমিজি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১০২)
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন ইহরাম বাঁধার ইচ্ছা করবে, তখন তার জন্য গোসল করা সুন্নত।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৫৮৪৭)
ইহরামের কাপড়-পরিধেয়
পুরুষদের দুইটি সাদা চাদর প্রয়োজন হবে, যা নতুনও হতে পারে কিংবা ধোয়াও হতে পারে। একটি লুঙ্গির মতো করে এবং অপরটি চাদর হিসাবে পরিধান করবে। কালো রঙের কিংবা পুরুষের জন্য অনুমোদিত এমন যেকোনো রংয়ের কাপড় পরিধান করাও জায়েয। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ চুল আঁচড়ালেন, তেল লাগালেন এবং লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করে মদীনা থেকে হজের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। তিনি জাফরানযুক্ত ব্যতীত অন্য কোনো চাদর ও লুঙ্গি পরতে নিষেধ করেননি।-সহীহ বুখারী ১/২০৯
জুতা- স্যান্ডেল পরার নিয়ম
পায়ের পাতার উপরের উঁচু অংশ খোলা থাকে এমন চপ্পল বা স্যান্ডেল পরা যাবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা লুঙ্গি, চাদর ও চপ্পল পরে ইহরাম গ্রহণ কর। যদি চপ্পল না থাকে তবে চামড়ার মোজা পায়ের গীরার নিচ পর্যন- কেটে তা ব্যবহার করতে পারবে।-মুসনাদে আহমদ হাদিস: ৪৮৮১
ইহরামের সুগন্ধি ব্যবহার
ইহরামের আগে খালি শরীরে আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা মুস্তাহাব। শরীরের আতর ও ঘ্রাণ যদি ইহরাম বাঁধার পর অবশিষ্ট থাকে, তবুও কোনো অসুবিধা নেই। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম গ্রহণের সময় তাঁর সর্বাধিক উত্তম সুগন্ধিটি ব্যবহার করতেন। তিনি বলেন, ইহরাম বাঁধার পর তার শ্মশ্রু ও শির মোবারকে তেলের ঔজ্জ্বল্য দেখতে পেতাম।’ (মুসলিম: ১/৩৭৮)
ইহরামের কাপড়ে আতর বা সুগন্ধি লাগাবে না। কারণ, ইহরামের পরও অবশিষ্ট থাকে—এমনভাবে আতর বা সুগন্ধি লাগানো নিষেধ। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪৮৯; গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা: ৭০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২২২; মানাসিক মোল্লা আলী কারি, পৃষ্ঠা: ৯৮)
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা (ইহরাম অবস্থায়) এমন কোনো কাপড় পরিধান করবে না যা জাফরান বা ওয়ারসযুক্ত। (মুসলিম: ১/৩৭২)
দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া
মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে ইহরাম গ্রহণের পূর্বে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া। (গুনইয়াতুন নাসিক ৭৩; মানাসিক মোল্লা আলী কারি, পৃষ্ঠা: ৯৯; রদ্দুল মুহতার ২/৪৮২
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) হজের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে রওনা হয়ে জুলহুলাইফাতে পৌঁছলেন এবং দুই রাকাত নামাজ পড়লেন। অতঃপর জুলহুলাইফার নিকট যখন উটনী তাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল তখন তিনি তালবিয়া পাঠ করলেন…। (মুসলিম: ১/৩৭৬)
ইহরামের নিয়ত করা
(পুরুষ হলে টুপি বা মাথার কাপড় খুলে ফেলতে হবে) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, মুখমণ্ডল ও তার উপরের অংশ মাথার অন-র্ভুক্ত। অতএব ইহরাম গ্রহণকারী থুতনী থেকে উপরের কোনো অংশ আবৃত করবে না।-মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা হাদিস : ১৪৪৫২
নিয়ত হতে হবে আলাদা
তামাত্তুকারী শুধু ওমরার নিয়ত করবে, ইফরাদকারী শুধু হজের নিয়ত এবং কিরানকারী হজ ও ওমরার নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করবে। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. বলেন, আমরা বিদায় হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে বের হলাম। আমাদের মধ্যে কেউ শুধু ওমরার উদ্দেশ্যে তালবিয়া পাঠ করলেন, কেউ হজ-ওমরা দু’টোর উদ্দেশ্যে এবং কেউ শুধু হজের উদ্দেশ্যে তালবিয়া পাঠ করলেন। (মুসলিম ১/২১২