আশুলিয়াপ্রধান শিরোনামস্থানীয় সংবাদ
সৌদিতে যৌন নির্যাতনের শিকার আশুলিয়ার সুমি আক্তার
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ‘কমপক্ষে ২ বার আমাকে বেচাকেনা ও হাত বদল করা হয়েছে। ঢাকা থেকে রিয়াদে পৌঁছানোর পর গভীর রাতে পথ বদল, মানুষ বদল, গাড়ি বদল করে ১৫ দিনে আমাকে মরুভূমির মতো একটি এলাকায় নিয়ে তালা মেরে রাখা হয়। ১০ কক্ষের ঐ বিশাল বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথম কয়েকদিন আমাকে তেমন কাজ করতে হয়নি। সকাল হলেই একজন আরব নারী ঘরে তালাবদ্ধ রেখে বাইরে চলে যেতেন। সপ্তাহ না ঘুরতেই শুরু হয় আমার ওপর যৌন নির্যাতন, তখন বুঝতে পারি আমাকে অবৈধ কাজের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। ’
কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই নিজের মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের কথা বলছিলেন কিছুদিন আগে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার সেই নারী। আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকায় তার গ্রামের বাড়ি।
সুমি আক্তার জানান, সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে তার মতো অনেক বাংলাদেশি নারীকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চক্রের হাতে পাচার হওয়া এরকম একজন বাংলাদেশি নারীর দাম নাকি প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। এই নারীদের বেশির ভাগ দালালের মাধ্যমে রাজধানীর পুরনো পল্টন এলাকার একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক আক্তার হোসেনকে টাকা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
পল্টন থানার উপ–পরিদশর্ক রিজাউল হক বলেন, পাচারের সঙ্গে জড়িত ঐ এজেন্সির মালিকের বিরুদ্ধে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। শনিবার রাতে আক্তার হোসেনের সাথে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার দুটো মুঠোফোনই সচল পাওয়া যায়।
এর আগে, বাংলাদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বিদেশে এক নির্যাতিতা বাংলাদেশি নারীর বাঁচার আকুতির ভিডিও ভাইরাল নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। যেখানে ঐ নারী বলেন, আমি মনে হয় আর বাঁচবো না, আমি মনে হয় মরেই যাব। আমি এখানে খুবই কষ্টে আছি। আমি চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমি জানি না এখান থেকে কি করে রক্ষা পাব। আমার আগের বাসায় অনেক নির্যাতন করেছে। ১৫ দিন এক ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করেছে, কিছু খেতে দেয়নি। ওখান থেকে আরেক জায়গায় পাঠিয়েছে সেখানেও নির্যাতন করা হচ্ছে। আমাকে গরম তেল দিয়ে হাত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমারকে বেঁধে মারধর করা হয়েছে। আমাকে বাঁচাও। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও…।
জানা যায়, গত ৫ মে আক্তার হোসেন উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকৃত দালাল মাজেদা বেগমের সহযোগিতায় উচ্চ বেতনে মেডিকেলে চাকরীর প্রলোভন দেখিয়ে সুমিকে সৌদি আরবে নিয়ে যায়। তারপর থেকে স্ত্রীর সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করতে না পেরে তার স্বামী ঐ আক্তার হোসেনকে চাপ প্রয়োগ করেন। তখন তার স্বামীকে এক মাসের বেতন বাবদ ১৭,৭০০ টাকা দেন এবং স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ হলে তিনি জানান যে, সৌদিতে তার উপর শারীরিক মানসিক ও যৌন নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এই বিষয়ে তার স্বামী তখন আক্তার হোসেনের অফিসে গেলে তাকে বিভিন্ন প্রকার হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে অফিস থেকে বের করে দেয় আক্তার। নিরুপায় হয়ে সুমির স্বামী পল্টন থানায় একটি জিডি করেন। জিডি নং–৬৮৬, তাং ১১-০৯-২০১৯ইং। গত অক্টোবরের ১০ তারিখে তিনি ন্যায় বিচারের জন্য মহাপরিচালক, জনশক্তি কর্মসংস্থান রপ্তানি ব্যুরোতে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।
পরে এ বিষয়ে আক্তার হোসেন ওই নারীর স্বামী মোবাইল ফোনে জানান যে, তার স্ত্রী আগে যে বাসায় ছিলো সেখানে নির্যাতন হলেও বর্তমানে যেখানে দিয়েছি সেখানে ভালো আছে। তাছাড়া তার নির্যাতনের অভিযোগের বিষয় আমরা ভিসা অফিসে জানিয়েছি।
নির্যাতিতা নারী সুমির মা চন্দ্রভানু বলেন আমার মেয়ে সুমি আক্তারের দুইটি সন্তান রয়েছে সিরাফ হোসেন ও রিফাত। তারা মাকে ফেরত চায়।
ভুক্তভোগীর স্বামী নুরুল ইসলাম বলেন, এজেন্সি তার স্ত্রীকে বিদেশে পাঠায়। এরপর নির্যাতনের কথা তিনি সেখানে গিয়ে সব বলেন । এজেন্সির মালিক জানান, কোনোভাবেই ৬ মাসের আগে ফেরত আনা সম্ভব না। বেশ কয়েক দিন পর জানান, দেড় লাখ টাকা দিলে তারা চেষ্টা করবেন।
জানতে চাইলে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলেন, ‘এমন অভিযোগ আমাদের কাছে এখনো আসেনি। সৌদিতে ওই নারীকে কোন এজেন্সি গ্রহণ করেছে ও স্মার্ট কার্ডে কাদের নাম আছে, সেটা জানতে পারলে এখানকার এজেন্সির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবে এ দেশের সরকার।
এ বিষয়ে আশুলিয়ার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলেন, আমরা ভিডিওটি দেখার পর সুমির স্বামীর সঙ্গে কথা বলি। সেই সঙ্গে তার স্বামীকে সব রকমের সাহায্য করছি। মেয়েটাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি ।
সৌদি আরবে নারী শ্রমিক নির্য়াতনকারীদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি বেনজির আহমেদ। তিনি বলেন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক নির্যাতন বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নির্যাতন নিয়ে আমরা মন্ত্রণালয়কে জানালে সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। যে নিয়োগকর্তা নারী শ্রমিককে নিয়োগ দিয়েছে, নির্যাতনের জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এই ব্যাপারে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মারুফ হোসেন সরদার বলেন, সৌদি আরবে নারী কর্মীদের ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনএইচ/আরএম