তথ্যপ্রযুক্তিপ্রধান শিরোনাম
সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকবে বেসরকারি খাত?
সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: বাংলাদেশে সরকারিভাবে দুটি সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ আছে। নতুন আরও একটি আসছে। ইতোমধ্যে সরকার বেসরকারি খাতে এই লাইসেন্স উন্মুক্ত করেছে। সম্প্রতি তিনটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্সও দেওয়া হয়েছে। সরকার বলছে, ২০৪০ সাল পর্যন্ত দেশে ব্যান্ডউইথের যে চাহিদা হবে—তা সরকারি সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ দিয়েই মেটানো যাবে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বেসরকারি খাতের তিন সাবমেরিন ক্যাবলের সংযোগ চালু হলে তারা কিভাবে টিকে থাকবে? এ প্রসঙ্গে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বলেছেন, ‘আমরা সেবা দিয়েই টিকে থাকবো। তখন সেবার মান দেখবে গ্রাহকরা। এখন কোনও অপশন নেই বলে সরকারি সেবার ওপর নির্ভর করতে হয়। বেসরকারি খাতেরগুলো চালু হলে বাজারে কোনও মনোপলি থাকবে না, সেবার মান থাকবে উন্নত। ফলে গ্রাহক যার কাছ থেকে ভালো সেবা পাবে তার কাছ থেকেই সেবা নেবে।’
বিনিয়োগ প্রসঙ্গে আলোচনা হলে তারা বলেন, ‘সাবমেরিন ক্যাবলের জন্য বিশাল অংকের বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। সেই বিনিয়োগ তুলে আনার জন্য তারা ইতোমধ্যে পরিকল্পনা করেছন। দেশের ব্যান্ডউইথের চাহিদা মেটানোর পরে উদ্বৃত্ত থাকলে এবং সরকারের অনুমতি পেলে তারা দেশের বাইরে রফতানি করতে আগ্রহী।’
প্রসঙ্গত, দেশে বর্তমানে ৩৮৫০ জিবিপিএস (গিগাবিটস পার সেকেন্ড) ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে অর্ধেক এবং বাকি অর্ধেক আইটিসির (ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল) মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ ভারত থেকে আমদানি করে চাহিদা মেটানো হচ্ছে।
বেসরকারি খাতের সাবমেরিন ক্যাবলের লাইসেন্স পাওয়া ৩ প্রতিষ্ঠান হলো মেটাকোর সাবকম লিমিটেড, সামিট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড ও সিডিনেট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ডাক ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মনোপলি ভাঙার জন্য বেসরকারি খাতে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। ফলে বেসরকারিভাবে যারা আসবে তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। ফলে গ্রাহক উপকৃত হবে। গ্রাহক এখন ৬১ টাকা দামে ব্যান্ডউইথ কিনতে পারে বলে তিনি জানান।
তিনি জানান, সম্প্রতি সাবমেরিন ক্যাবল সি-মি-উই-ফোরের সক্ষমতা ৩ গুণ বাড়ানো হয়েছে। সি-মি-উই-সিক্সে ১৩ টেরাবাইট ব্যান্ডউইথ পাওয়া যাবে। ফলে দেশে যে পরিমাণ ব্যান্ডউইথ আসবে তা দিয়ে ২০৪০ সাল পর্যন্ত দেশের চাহিদা মেটানো যাবে। কারও ওপর নির্ভর করতে হবে না। তিনি আরও বলেন, আমরা ত্রিপুরায় ২০ জিবিপিএস (গিগাবিটস পার সেকেন্ড) রফতানি করছি, আসামে ১০০ জিবিপিএস রফতানি করবো। সৌদি আরবে দিচ্ছি ৬০০ জিবিপিএস। তারা আরও নিতে চায়। মালয়েশিয়া ও ফ্রান্স যথাক্রমে নিচ্ছে ২০০ ও ১৩ জিবিপিএস। ভুটানও ব্যান্ডউইথ নিতে আগ্রহী বলে মন্ত্রী জানান।
জানা গেছে, গত ১০ মে আবেদন জমা দেওয়া শেষ দিন পর্যন্ত ৬টি প্রতিষ্ঠানের আবেদন জমা পড়ে। লাইসেন্সের জন্য সামিট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড, ফাইবার অ্যাট হোম লিমিটেড, সিডিনেট, ম্যাঙ্গো টেলিসার্ভিসেস লিমিটেড, টোটাল সলিউসন্স লিমিটেড ও মেটাকোর সাবকম লিমিটেড আবেদন জমা দেয়।
‘বিল্ড, অপারেট অ্যান্ড মেইনটেইন সাবমেরিন ক্যাবল ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি গাইডলাইনও তৈরি করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয় বেসরকারি খাত থেকে সাবমেরিন ক্যাবলের লাইসেন্স দেওয়া হবে। লাইসেন্স পাওয়ার পরে প্রতিষ্ঠানগুলো সাবমেরিন ক্যাবলের অপারেশন চালু করতে অন্তত ৪ বছর সময় পাচ্ছে।
বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে সি-মি-ইউ-৪, সি-মি-ইউ-৫। আসছে সি-মি-ইউ-৬ সাবমেরিন ক্যাবল।
লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান মেটাকোর সাবকম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা আহমেদ জুনায়েদের কাছে তাদের পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে আমরা একটা সাবমেরিন ক্যাবল আনার চেষ্টা করছি। সিঙ্গাপুরভিত্তিক কাম্পানা একটা ক্যাবল ‘লে’ করার চেষ্টা করছে। আমরা চেষ্টা করছি ক্যাবলটি থেকে সরাসরি বাংলাদেশ পর্যন্ত সংযোগ নিয়ে আসার। এর ফলে ল্যাটেন্সি কম হবে। এখন যেকোনও সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে সিঙ্গাপুরে সংযুক্ত হলে ল্যাটেন্সি টাইম ৪৫ মিলি সেকেন্ড। আমরা সরাসরি ক্যাবল নিয়ে এলে ল্যাটেন্সি টাইম হবে ৩০ মিলিসেকেন্ড। ক্যাপাসিটি বিপুল পরিমাণে বাড়বে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এছাড়া ভারতের জিও এবং জাপানের এনটিটি সঙ্গে কথা চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা ভালো সুবিধা দেবে তাদের কাছ থেকেই আমরা ক্যাবল নিয়ে আসার চেষ্টা করবো। বেসরকারি পর্যায়ে দেশে সাবমেরিন ক্যাবল এলে এতে সাবমেরিন ক্যাবলেরই রিডানডেন্সি বাড়বে। এখন সাবমেরিন ক্যাবলের বিকল্প হলো আইটিসি (ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল)। বেসরকারি সাবমেরিন ক্যাবল দেশে এলে সাবমেরিন ক্যাবলই এর বিকল্প হবে। তখন দেশের সক্ষমতা বাড়বে এবং দেশের টাকা দেশেই থাকবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয় মার্কেটই আমাদের টার্গেট। আমরা আগে দেশের চাহিদা পূরণ করতে চাই। এরপর যদি সরকারের অনুমতি পাই তাহলে বিদেশেও ব্যান্ডউইথ রফতানি করতে পারবো। আমাদের প্রাথমিক টার্গেট কলকাতা ও ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্য। বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ দেশে আনার জন্য সাধারণত ব্যয় হয় ৭০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকার মতো। আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
সামিট কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ আল ইসলাম বলেন, শর্ত অনুযায়ী লাইসেন্স পাওয়ার ৪ বছরের মধ্যে সাবমেরিন ক্যাবলের অপারেশনে আসতে হবে। আমাদের ইচ্ছা ২-৩ বছরের মধ্যে সাবমেরিন ক্যাবলের সংযোগ নিয়ে আসবো।
সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ আনতে কী পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজেট নির্ভর করে কনসোর্টিয়াম, কোথা থেকে আনা হচ্ছে, দূরত্ব, ল্যান্ডিং স্টেশন, ডিস্ট্রিবিউশন ইত্যাদির ওপর। স্থানীয় চাহিদা বাড়ছে, সেই চাহিদা পূরণ করতে আমরা সচেষ্ট থাকবো। দেশের বাইরে ব্যান্ডউইথ লিজ দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে আরিফ আল ইসলাম বলেন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এসব দেশে ব্যান্ডউইথের গড় ব্যবহার কম। ফলে ওইসব দেশে আমাদের নজর থাকবে।
আরিফ আল ইসলাম জানান, তাদের পরিকল্পনায় রয়েছে ভারতের রিলায়েন্সের জিও, এনটিটি জাপান এবং সিঙ্গাপুরের কাম্পানা সাবমেরিন ক্যাবল থেকে তাদের সংযোগ আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বেসরকারি খাতে সাবমেরিন ক্যাবল দেশে এলে একচেটিয়া (মনোপলি) ব্যবসা থাকবে না। সবাইকে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। গ্রাহক তখন কম দামে ব্যান্ডউইথ পাবে।
তবে দাম কম হলেই যে গ্রাহক সেই ব্যান্ডউইথ নেবে এমনটা নাও হতে পারে বলে মত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজনের। তিনি বলছেন, ‘বিটিসিএল’র ব্যান্ডউইথের দাম কম হওয়ার পরও গ্রাহকরা আইটিসি থেকে ব্যান্ডউইথ নিয়ে থাকে। দাম কম হওয়ায় কী সবাই বিটিসিএলে চলে গেছে? বিএসসিসিএল (বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড) এবং আইটিসির ব্যান্ডউইথ ব্যবহারের হার প্রায় সমান। বিএসসিসিএল থেকে ব্যান্ডউইথের জন্য ডিমান্ড নোট দিলে ১৫-২০ দিন লাগে তা পেতে। তাহলে কে যাবে বিএসসিসিএল’র কম দামের ব্যান্ডউইথ নিতে? অন্যান্য ঝামেলা তো আছেই।’