প্রধান শিরোনামব্যাংক-বীমাশিল্প-বানিজ্য

সব ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ আগামী এপ্রিল থেকে

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ ক্রেডিট কার্ড ছাড়া ব্যাংকের সব ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ আগামী ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। সোমবার এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

‘ঋণ/বিনিয়োগ এর সুদ/মুনাফা হার যৌক্তিকীকরণ’ শীর্ষক সার্কুলারে বলা হয়েছে, লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বর্তমানে ব্যাংকের ঋণ/বিনিয়োগের উচ্চ সুদ/মুনাফা হার দেশের ক্ষুদ্র, মাঝারী ও বৃহৎ শিল্পসহ ব্যবসা ও সেবা খাতের বিকাশে প্রধান অন্তরায় হিসাবে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক ঋণ/বিনিয়োগের সুদ/মুনাফা হার উচ্চ মাত্রার হলে সংশ্লিষ্ট শিল্প, ব্যবসা ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।

“ফলে শিল্প, ব্যবসা ও সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ কখনো কখনো প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় বিধায় সংশ্লিষ্ট ঋণ/বিনিয়োগ গ্রহিতাগণ যথাসময়ে ব্যাংক ঋণ/বিনিয়োগ পরিশোধে সমর্থ হয় না। ব্যাংকিং খাতে ঋণ শৃংখলা বিঘ্নিত হয় এবং সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।”

এ প্রেক্ষাপটে শিল্প, ব্যবসা ও সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে অধিক সক্ষমতা অর্জনসহ শিল্প ও ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ঋণ/বিনিয়োগ পরিশোধে সক্ষমতা এবং কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে নিচের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছেঃ

  • ক্রেডিট কার্ড ব্যতীত অন্যান্য সকল খাতে অশ্রেণিকৃত ঋণ/বিনিয়োগের উপর সুদ/মুনাফা হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো।
  • কোন ঋণ/বিনিয়োগের উপর উল্লিখিতভাবে সুদ/মুনাফা হার ধার্য করার পরও যদি সংশ্লিষ্ট ঋণ/বিনিয়োগ গ্রহিতা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয় সেক্ষেত্রে যে সময়কালের জন্য খেলাপি হবে অর্থাৎ মেয়াদী ঋণ/বিনিয়োগের ক্ষেত্রে খেলাপি কিস্তি এবং চলতি মূলধন ঋণ/ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মোট খেলাপি ঋণ/ বিনিয়োগের উপর সর্বোচ্চ ২ শতাংশ হারে দন্ড সুদ/অতিরিক্ত মুনাফা আরোপ করা যাবে।
  • প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণের বিদ্যমান সর্বোচ্চ সুদ/মুনাফা হার ৭ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকবে।
  • সুদ/মুনাফা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দন্ডসুদ/অতিরিক্ত মুনাফা ব্যতিরেকে ঋণ/ বিনিয়োগের উপর অন্য কোন সুদ/মুনাফা/দন্ডসুদ/অতিরিক্ত মুনাফা আরোপ করা যাবে না।
  • চলতি বছর হতে ব্যাংকের মোট ঋণ/বিনিয়োগ স্থিতির মধ্যে এসএমই’র ম্যানুফ্যাকচারিং খাতসহ শিল্প খাতে প্রদত্ত সকল ঋণ/বিনিয়োগ স্থিতি অব্যবহিত পূর্ববর্তী ৩ বছরের গড় হারের চেয়ে কোনভাবেই কম হতে পারবে না।
  • ১ এপ্রিল হতে এ নির্দেশনা কার্যকর হবে।
  • ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ সার্কুলার জারি করা হলো।

দেড় বছরেরও বেশি সময় নয়-ছয় সুদহার (ব্যাংক ঋণের ৯ এবং আমানতের ৬ শতাংশ সুদ হার) বাস্তবায়নের জন্য সরকার ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে আসছে। সরকারি ব্যাংকগুলো এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন শুরু করলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো ‘নানা অজুহাতে’ গড়িমসি করছিল।

এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেওয়ার পরও ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অংকে (সিঙ্গেল ডিজিট) নামিয়ে আনেনি বেসরকারি ব্যাংকগুলো।

গত ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে উৎপাদন খাতে অর্থাৎ শিল্প খাতে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এরপর ৩০ ডিসেম্বর ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এবং ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) নেতাদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়ে যে, ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণের সুদ হার হবে ৯ শতাংশ। জানুয়ারি নয়, এপ্রিল থেকে এই হার কার্যকর হবে।

ওই বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমরা কথা দিয়েছিলাম ১ জানুয়ারি থেকে নয়-ছয় সুদ হার বাস্তবায়ন করব। আজ পর্যন্ত আমরা সেই সার্কুলার দিতে পারিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনার আলোকে সব হবে। আমরা প্রথমে যেভাবে সার্কুলার করতে চেয়েছিলাম, প্রধানমন্ত্রী তা রেখেছেন। সঙ্গে কিছু সংশোধন করেছেন। সেই সংশোধন করে বাস্তবায়ন করতে কিছু সময় লাগবে।”

“আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ৯ শতাংশ সুদ শুধু উৎপাদন খাতে কার্যকর হবে। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর হবে।এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চাহিদা।”

তবে ঢালাওভাবে সব ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ করা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলো।

১৪ জানুয়ারি গভর্নর ফজলে করিমের সঙ্গে বৈঠকে বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা বলেছেন, তারা উৎপাদন খাতে ৯ শতাংশ হারে ঋণ বিতরণ করতে পারলেও ভোক্তা ঋণ ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে এই হারে ঋণ বিতরণ করতে পারবে না।

এই দুই খাতে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দিলে ব্যাংকগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে জানিয়েছিলেন তারা।

এ প্রসঙ্গে সোমবার রাতে এবিবি’র চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আপত্তি নয়; আমরা অনুরোধ করেছিলাম, ভোক্তা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ঋণ যেনো ৯ শতাংশ বেধে দেওয়া না হয়। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেমনটা বলেছে, আমরা সেটাই মেনে চলব।

“তবে সার্কুলারে আমানতের সুদের হারের বিষয়ে কিছু বলা নাই। নয়-ছয় সুদেরহার যে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল তার একটি অংশ হিসাবে এই সার্কুলারকে আমরা দেখছি। আমানতের সুদের হারের বিষয়টি কখন দেবে সেটাএখন দেখতে হবে।”

আমানতের সুদের হারের সার্কুলারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, “যে সার্কুলার জারি করা হয়েছে সেটা ঋণের সুদের হারের; আমানতের বিষয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।”

তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “চাপিয়ে দিয়ে সুদের হার কমবে বলে আমার মনে হয় না। সরকারি ব্যাংকগুলো কমালেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো কমাতে পারবে বলে মনে হয় না।
“কেননা, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি। এখন ব্যাংকগুলোকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির জন্যই অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। এরপর কম সুদে ঋণ নিলে তার আয় অনেক কমে যাবে যাবে।”

তিনি বলেন, “সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সবকিছুই যেখানে বাজারের উপর; সেখানে সুদের হারও বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। সেক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যাংক তার অন্যান্য খরচ কমিয়ে ৭/৮ শতাংশ সুদেও ঋণ বিতরণ করতে পারে সেটাও করবে।”

“বেঁধে দেওয়ার পক্ষপাতি আমি নই,” বলেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।

বর্তমানে ব্যাংক ভেদে উৎপাদন খাতে সুদ হার ১১ থেকে ১৪ শতাংশ।ভোক্তা এবং এসএমই ঋণের সুদের হার আরও বেশি।

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close