গার্মেন্টসপ্রধান শিরোনামশিল্প-বানিজ্য
শ্রমিকদের জুন মাসের মজুরি দেয়নি হাজারের বেশি কারখানা
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: শ্রমিকদের জুনের মজুরি দেয়নি হাজারের বেশি কারখানা চলতি মাসের তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এক হাজারের বেশি তৈরি পোশাক কারখানা শ্রমিকদের গত জুনের মজুরি দেয়নি। আবার চলতি মাসের শেষ দিন অথবা আগামী মাসের প্রথম দিনে পবিত্র ঈদুল আজহা। এর ফলে ঈদের আগে সব পোশাকশ্রমিকের মজুরি ও বোনাস পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
শ্রমিকনেতারা অভিযোগ করে বলেন, সময়মতো মজুরি না পেয়ে হাজারখানেক কারখানার শ্রমিক মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাঁদের প্রতিদিনের খাবারসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে কষ্ট হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর উদ্যোগ না নিলে ঈদের আগে মজুরি দেবেন না অনেক কারখানার মালিক।
শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুষ্টিয়া ও যশোরে ৭ হাজার ৬০২টি শিল্পকারখানা রয়েছে। তার মধ্যে গত রোববার পর্যন্ত ২ হাজার ২৯০টি জুনের মজুরি দেয়নি, যার অর্ধেকই পোশাক ও বস্ত্র খাতের কারখানা। তবে ঢাকা মহানগরীর কারখানার তথ্য এখানে নেই।
শিল্প পুলিশ বলছে, সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনায় তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য ১ হাজার ৮৮২ কারখানার মধ্যে ৪৭২টি গতকাল পর্যন্ত মজুরি দেয়নি। নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সদস্য ১ হাজার ১০১ কারখানার মধ্যে ৫৭১টি মজুরি দেয়নি। আর বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সদস্য ৩৮৯ কারখানার মধ্যে ১৩২টি মজুরি দেয়নি। তাতে তিন সংগঠনের ৩ হাজার ৩৭২ কারখানার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত মজুরি পরিশোধ করেনি ১ হাজার ১৭৫টি।
অবশ্য শিল্প পুলিশের পরিসংখ্যানের সঙ্গে একমত নয় বিজিএমইএ। তাদের দাবি, সংগঠনের সদস্যভুক্ত ১ হাজার ৯২৬টি সচল কারখানার মধ্যে গত রোববার পর্যন্ত ১ হাজার ৭১০টি মজুরি দিয়েছে। ২১৬ কারখানার মজুরি দেওয়া প্রক্রিয়াধীন । অন্যদিকে বিকেএমইএ বলছে, তাদের সচল কারখানার সংখ্যা ৮৩৩টি।
মার্চে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সরকার রপ্তানিমুখী শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য ৫০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। সেই তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানা মালিক মাত্র ২ শতাংশ সেবা মাশুলে ঋণ নিয়ে তিন মাসের মজুরি দিচ্ছেন। অন্যদিকে দুই মাসের ব্যবধানে পোশাক রপ্তানিতে গতি ফিরলেও ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। এপ্রিলে কারখানা বন্ধের সময়ে ৬৫ শতাংশ মজুরি দিয়েছেন। এমনকি শ্রমিকের ঈদ বোনাসেও হাত দিয়েছেন অধিকাংশ মালিক।
জানতে চাইলে বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে যেসব উদ্যোক্তা ঋণ পাননি, তাঁরা গত দুই মাস কষ্ট করে মজুরি দিয়েছেন। অন্যদিকে স্থগিত ও বাতিল ক্রয়াদেশের পণ্য রপ্তানি হলেও ক্রেতারা দাম দিতে ছয় মাস পর্যন্ত সময় নিচ্ছে। ফলে অনেকেই সময়মতো মজুরি দিতে পারছেন না।
করোনায় ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় গত এপ্রিলে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। পরের মাসে তা ১২৩ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। তবে জুনে পোশাক রপ্তানি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়ায়। রপ্তানি হয় ২২৫ কোটি ডলারের পোশাক। বর্তমানে নতুন ক্রয়াদেশ আসছে। সেটির পরিমাণ গতবারের চেয়ে ৭০-৮০ শতাংশ। আবার বাতিল ও স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশ পণ্যও রপ্তানি হচ্ছে বলে জানালেন কয়েকজন উদ্যোক্তা। এরপরও মজুরি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এ খাতের শ্রমিকেরা।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার জানান, মজুরি না পাওয়াটা করোনাকালে শ্রমিকদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসছে। কারণ, তাঁরা যে মজুরি পান, তা দিয়ে বর্তমান বাজারে চলতে হিমশিম খেতে হয়। তিনি বলেন, পোশাক কারখানার মালিকেরা অমানবিক হওয়ার যত রাস্তা আছে, সব দেখিয়ে ফেলছেন। এ পরিস্থিতিতে তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার শক্ত অবস্থান না নিলে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।
প্রতিবছর সরকার, মালিক ও শ্রমিক পক্ষ বৈঠক করে ঈদের আগে বেতন-ভাতা পরিশোধে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়। সেটিও শেষ পর্যন্ত অনেক কারখানা মানে না। তাতে অনেক শ্রমিককে নিরানন্দ ঈদ পার করতে হয়। গত ঈদুল ফিতরের আগে বেশ কিছু পোশাক কারখানা এপ্রিলের মজুরি ও ঈদের বোনাস পরিশোধ করেনি।
এবারের ঈদুল আজহার আগে ৫১৪টি পোশাক ও বস্ত্র কারখানার মজুরি এবং বোনাস পরিশোধ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে শিল্প পুলিশের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে বিজিএমইএর ৩৮২, বিকেএমইএর ৯২ ও বিটিএমএর ৪০টি কারখানা।
বেতন-ভাতা পরিশোধের সময়সীমা নির্ধারণে শুরুতে কিছুটা গড়িমসি করেছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। গত বুধবার শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে সব খাতের মালিকদের ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধের আহ্বান জানান শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। তবে সেখানে পোশাকশিল্পের মালিকেরা কেউ ছিলেন না। পরদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ঈদের আগে বেতন–ভাতা পরিশোধে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠলেও বাধা দেন মালিকপক্ষের নেতারা। অবশ্য গতকাল সরকার, মালিক-শ্রমিক ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ-টিসিসির সভায় ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে বোনাস ও ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে চলতি মাসের অর্ধেক মজুরি পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানতে চাইলে ইন্ডাস্ট্রিয়ল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাবেক মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন জানান, অনেক কারখানা এখনো শ্রমিকদের গত মাসের মজুরি দিতে পারেনি। তাতে ঈদের আগে বেতন-ভাতা পরিশোধে জটিলতার আশঙ্কা রয়েছে। তাই মাঠপর্যায়ে শক্ত তদারকির দাবি জানান তিনি। (সূত্র: প্রথম আলো)