কৃষিপ্রধান শিরোনামশিল্প-বানিজ্য
শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে চলতি বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে চলতি বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ। সাড়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ দিন পর্যন্ত ৯ লাখ ৪৩ হাজার ৯০২ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করা গেছে। ঘাটতি রয়েছে ১০ লাখ ৬ হাজার ৯৪ মেট্রিক টন। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি রোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও কোনো খাদ্য সংকট হবে না। তারা বলছেন, সাড়ে ১৪ লাখ মেট্রিক টন চাল মজুত রয়েছে।
চলতি বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ৩১ আগস্ট ছিল শেষ দিন। তবে ২৬ এপ্রিল থেকে শুরু করে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও সংগ্রহ করতে পারেনি সরকার। এ কারণে সময় আরও ১৫ দিন বাড়িয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর করা হয়। সর্বশেষ সময় পার হলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ঘাটতি রয়েছে ১০ লাখ ৬ হাজার ৯৪ মেট্রিক টন।
জানা গেছে, খাদ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতি, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের লটারি করতে করতেই প্রায় দেড় মাস সময় পার হওয়া, গুদামে ধান দিতে গিয়ে নানা ঝক্কি ঝামেলায় কৃষকের আগ্রহ হারানো, উৎকোচ দেয়া, করোনা, লাগাতার বৃষ্টি, বন্যার কারণে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।
খাদ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকার ১৯ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করার জন্য গত ২৬ এপ্রিল থেকে বোরো ধান এবং ৭ মে থেকে চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করে। সর্বশেষ সময় বাড়িয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ লাখ মেট্রিক টন। তবে শেষদিন ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বোরো ধান সংগ্রহ করা হয়েছে দুই লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। সিদ্ধ চালের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ মেট্রিক টন। সংগ্রহ হয়েছে ৬ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৭ মেট্রিক টন। আর আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। সংগ্রহ হয়েছে ৯৪ হাজার ৩৪৭ মেট্রিক টন।
জানা গেছে, আপৎকালীন মজুতের জন্য সরকার প্রতি বছর আমন ও বোরো মৌসুমে স্থানীয় চালকল মালিকদের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে চাল সংগ্রহ করে থাকে। তবে এবার মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে চলতি বোরো মৌসুমে সরকার এ সংগ্রহ অভিযানকে আরও বেশি গুরুত্ব দেয়। এজন্য এবার ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অন্যবারের চেয়ে আরও বেশি ধরা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের লটারি করতে করতেই প্রায় দেড় মাস চলে যায়। এর মধ্যেই কৃষকের হাত থেকে ধান মজুতদারদের গুদামে চলে গেছে। ফলে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সফল হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার কারণে যেকোনো দুর্যোগের সময় চাল সরবরাহে বিপদে পড়তে পারে সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা, আগাম বন্যা ও সারাবিশ্বে দুভিক্ষের আভাস পেয়ে অনেক গৃহস্থ এবার ধান হাতছাড়া করেননি। যারা মজুতদার তারাও ধান কাটা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধান ক্রয় করা শুরু করেন। মিলাররাও এ সময় ধান মজুত করেন। ফলে যেসব কৃষক ধান বিক্রি করেছেন, সেগুলো ইতোমধ্যে মজুতদারদের গুদামে চলে গেছে। মিলারদের সঙ্গে চালের জন্য সরকারের যে চুক্তি হয়েছে, সে চুক্তি অনুযায়ী অনেক মিলাররাও চাল দিতে পারেননি।
চাল কেনার জন্য কেজি ৩৬ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তবে একই চাল বাজারে ৪০-৪২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। মিলাররা বলছেন, বেশি দামে ধান কেনার কারণে কম দামে সরকারকে চাল সরবরাহ সম্ভব হয়নি।
বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় কর্তব্যরত খাদ্য নিয়ন্ত্রক, কর্মকর্তা ও গুদাম ইনচার্জদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধান-চাল সংগ্রহের সময় প্রায় ১০ জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক, বেশকিছু উপজেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও গুদাম ইনচার্জকে বদলি করা হয়েছে। ধান-চাল সংগ্রহের এই সময় তাদের বদলি করার কারণে অনেক জায়গায় ধান-চাল সংগ্রহ করা যায়নি। কারণ একজন খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে স্থানীয় মিলার এবং ধান সরবরাহ কৃষকসহ অনেকের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের নিজস্ব সম্পর্কের কারণেই তারা ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু এই সময় হঠাৎ বদলির ঘটনা সবকিছু থমকে দিয়েছে।
জানা গেছে, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, নীলফামারী, গাজীপুর, ভোলা, শরীয়তপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের বদলি করা হয়েছে। ধান-চাল সংগ্রহের সময় আগে কখনো এমন বদলির ঘটনা ঘটেনি। নতুন একজন কর্মকর্তা যোগদান করেই তার সফলতা দেখানো অনেকটা কঠিন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া কিছু কিছু জেলার খাদ্য কর্মকর্তারা ধান-চাল সংগ্রহের চাইতে অন্য দিকে মনোনিবেশ করায় যেমন-ভালো চাল গুদাম থেকে বের করে দিয়ে গুদামে নিম্নমানের চাল ঢোকানো, নতুন বস্তার পরিবর্তে পুরাতন বস্তা ঢোকানোসহ নানা পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকা এবং উপরি কামাইয়ের কারণেও অনেক জেলায় ধান-চাল সংগ্রহ করে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
খাদ্যসচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আমরা পূরণ করতে পারিনি। সাড়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টনের কাছে সাড়ে ১১ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারলেও সেটা সন্তোষজনক হতো।
তিনি বলেন, কৃষক এবার ধানের ভালো দাম পাওয়ার কারণে বাইরে ধান বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।
তবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও কোনো সমস্যা মনে করছেন না খাদ্যসচিব। তিনি বলেন, ‘আমাদের খাদ্যের কোনো সংকট হবে না। ফুড সিকিউরিটিতে আমরা ভালো অবস্থানে আছি। কারণ সাড়ে ১৪ লাখ মেট্রিক টন চাল আমাদের স্টকে আছে। তাছাড়া আর কিছুদিন পরেই আমনের মৌসুম শুরু হবে। আমন মৌসুমে আমরা ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারলে খাদ্যের ব্যাপারে কোনো ক্রাইসিস সৃষ্টি হবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সারওয়ার মাহমুদ বলেন, ‘এবার টার্গেট অনেক বেশি। তার মধ্যে বৈরী আবহাওয়া ও করোনার মতো দুর্যোগ। এটা নরমাল বছরের মতো সময় নয়। এমতাবস্থায় টার্গেট ফিলআপ হওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টায় ছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘কৃষক এবার ধানের ভালো দাম পাওয়ার কারণে বাজারেই ধান বিক্রি করে দিয়েছে। কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পেয়েছে-এটাও সরকারের বড় অ্যাচিভমেন্ট।
/এন এইচ