প্রধান শিরোনামবিশেষ প্রতিবেদনসাক্ষাৎকার
শীতের আগেই করোনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনাঃ ড. বিজন কুমার
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ দেশে করোনা ভাইরাসের গতিবিধি নিয়ে যারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তাদের একজন ড. বিজন কুমার শীল। বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. বিজন প্রথম আলোচনায় এসেছিলেন ছাগলের রোগ প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কার করে। তিনি বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছিলেন ২০০৩ সালে সিঙ্গাপুরে ছড়ানো সার্স ভাইরাস শনাক্তের কিট উদ্ভাবন করে। এবার তার নেতৃত্বে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র করোনা শনাক্তে র্যাপিড ডট ব্লট কিট উদ্ভাবন করেছে। তবে এখনও তা সরকারের অনুমোদন পায়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) তাদের কিটের সক্ষমতা যাচাই হলেও, তার ভিত্তিতে উৎপাদন, বাজারজাতকরণের অনুমতি দেয়নি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। তারা পুনরায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত কিটের সক্ষমতা যাচাইয়ের সুপারিশ করেছে।
সোমবার (৬ জুলাই) সকালে তাদের উদ্ভাবিত কিট, দেশে করোনার গতিবিধির খুঁটিনাটি বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কিট উদ্ভাবক দলের প্রধান বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সিআরও’র মাধ্যমে আপনাদের পুনরায় কিটের সক্ষমতা যাচাই করতে বলেছে। এবার তা কোথায় করানোর চিন্তা করছেন?
ড. বিজন কুমার শীলঃ ইউএস এফডিএ আমব্রেলা গাইডলাইনসে বলা হয়েছে, যে স্যাম্পল পরীক্ষা করা হবে, এটাকে ওয়েল ক্যারেক্টারাইজড (ভালো বৈশিষ্ট্যের) করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে যে, স্যাম্পলের মধ্যে কোভিড-১৯ আছে। এটা করার জন্য যে টেস্ট দরকার সেটা বাংলাদেশে একমাত্র আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আইসিডিডিআরবি) আছে এই মুহূর্তে। এ জন্য আমরা ওষুধ প্রশাসনকে বলেছি, এটা আমরা আইসিডিডিআরবিতে করাতে চাই। তারা বলেছেন, আমাদের কোনো আপত্তি নাই- আপনারা যেখানে খুশি, সেখানে করান। কিন্তু এটার পুনঃপরীক্ষা করতে হবে। মনে হয়, আমাদের কোভিড-১৯ ডট ব্লট কিট প্রকল্পের সমন্বয়ক ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার যোগাযোগ করেছেন আইসিডিডিআরবিতে।
বিএসএমএমইউ আপনাদের কিটের একটি অংশের ফল দিয়েছে, মানে অ্যান্টিবডি অংশের। অ্যান্টিজেন্ট অংশের ফলাফল এখনও দেয়নি বিএসএমএমইউ। এখন ওষুধ প্রশাসন কি আপনাদের অ্যান্টিজেন্ট ও অ্যান্টিবডি- দুটোরই পুনরায় সিআরও’র মাধ্যমে কার্যকারিতা যাচাই করতে বলেছে?
বিজন কুমার শীলঃ দুটোই করাতে বলেছে। আর অ্যান্টিজেন্টের ড্রাফট গাইডলাইন আমরা পেয়েছি। ওটার ওপর আমরা পড়াশোনা করছি। তারপর সরকার একটি নতুন গাইডলাইন সম্ভবত এ সপ্তাহেই দেবে। তখন আমরা অ্যান্টিজেন্ট ট্রায়ালে চলে যাব।
বিএসএমএমইউ আপনাদের অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা যাচাই করতে বেশ সময় নিয়েছিল। আইসিডিডিআরবিও কি তেমন সময় নিতে পারে?
বিজন কুমার শীলঃ না, এবার এত সময় লাগবে না। কারণ ওই সময় কোনো গাইডলাইন ছিল না। এখন আমরা যে ইউএস এফডিএ আমব্রেলা গাইডলাইন পেয়েছি, এটা খুবই সহজ। যদি স্যাম্পল থাকে, তাহলে সাত দিনেই পরীক্ষা করা সম্ভব।
তাহলে আইসিডিডিআরবির কাছ থেকে কত দিনের মধ্যে কিটের কার্যকারিতার ফল আশা করছেন?
বিজন কুমার শীলঃ আশা তো অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু আশা তো কখনও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তবে আমরা আশা ছাড়ছি না। দেখা যাক তারা কত দ্রুত দেয়।
জুনের মাঝামাঝি সময় আপনি আমাদের বলেছিলেন- ‘আমরা ইতোমধ্যে করোনার পিক টাইমে চলে এসেছি কিংবা কাছাকাছি এসেছি’। জুন পেরিয়ে গেছে। এখন আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
বিজন কুমার শীলঃ করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণ কিংবা সর্বনিম্ন সংক্রমণ নির্ভর করবে এলাকাভিত্তিক। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে এক প্রদেশে পিক হচ্ছে, আরেক এলাকায় শুরু হচ্ছে। যার জন্য সারাদেশের সর্বোচ্চ সংক্রমণের চিত্র দিতে পারছে না তারা, তবে ইউরোপের দেশগুলো পেরেছিল। আমার মনে হয়, ঢাকা শহরে সর্বোচ্চ সংক্রমণ পার হয়ে গেছে। এখন সংক্রমণ কমার মধ্যে আছে। আমাদের সামান্য গবেষণায় পেয়েছি, অসংখ্য মানুষের মধ্যে ইমিউনিটি (করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা) এসেছে। যদি কোনো পরিবারের একজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকে, ওই পরিবারের বাকিদের মধ্যে হরাইজেন্টালি স্পিড (আনুভূমিক সংক্রমণ) করেছে। যেটাকে বলা হয়, মাইল ইনফেকশন (করোনার মৃদু উপসর্গ দেখা যাওয়া) হয়ে তাদের মধ্যে অ্যান্টিবডি ডেভেলপ করেছে। এ জাতীয় মানুষের সংখ্যা অসংখ্য।
আপনি একটা হিসাব করে দেখবেন, এ যাবৎ কতগুলো কল এসেছে। করোনা সাসপেক্টেড (সন্দেহভাজন) বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হটলাইনে কল এসেছে। কত কোটি এসেছে। ওই কোটির সাথে আপনি চার দিয়ে গুণ দেন। তাহলে কত হয়, দেখেন। এটাই হচ্ছে মানুষের টোটাল এক্সপোজার (মোট আক্রান্ত)। তারা কিন্তু ইতোমধ্যে অ্যান্টিবডি ডেভেলপ করেছে। যে সময়টা মানুষের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা হয়েছে, তাদের মধ্যে কম-বেশি সবার মধ্যে ইনফেকশন ছিল। আগে থেকেই যাদের শারীরিক সমস্যা ছিল, তাদের বেশি হয়েছে। যাদের সমস্যা ছিল না, তাদের খুব কম হয়েছে বা একেবারেই উপসর্গ দেখা যায়নি। পরিবারের একজনের হলে বাকিদের মধ্যে হরাইজেন্টালি ট্রান্সমিট (আনুভূমিক সংক্রমণ) করেছে। যার একবার হয়েছে, সে মাস্ক পরা শুরু করেছে। পরিবারের সবাই তখন মাস্ক পরা শুরু করেছে। তখন দেখা গেছে, ভাইরাসটা ট্রান্সমিশন হয়েছে, কিন্তু খুব কম, সামান্য পরিমাণে। কিন্তু সেটা আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে স্টিমুলেট (চাঙ্গা) করেছে এবং অ্যান্টিবডি বেরিয়ে এসেছে। সেটা কম হোক আর বেশি হোক, কিন্তু হইছে।
আমরা এটা পর্যবেক্ষণে পেয়েছি। গতকাল একটা পরিবারের স্যাম্পল দেখলাম- প্রথমে একজন পিসিআরে করোনা পজিটিভ ছিল, বাকি ৮ জনের মধ্যে অ্যান্টিবডি চলে এসেছে। হয়তো আপনি অনুভব করেন যে, মাথাব্যথা হচ্ছে বা একটু পেটে সমস্যা, সামান্য কাশি- পরে সেরে গেছে। এই সংখ্যা কিন্তু বাংলাদেশে এখন অনেক। তারা কিন্তু আমাদের দেশের ভাইরাসকে ইরাডিকেট (ধ্বংস) করতে সাহায্য করবে। কারণ এই মানুষগুলোর মধ্যে ভাইরাস আর গ্রো (টিকতে না পারা) করতে পারবে না। না করতে পারলে ভাইরাস কিন্তু আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাবে।
ঢাকা শহরের সংক্রমণ নামতে কত দিন লাগবে?
ড. বিজন কুমার শীলঃ ঢাকা শহর পিক থেকে নামছে। নামতে নামতে শূন্যের কাছাকাছি যেতে আরও সময় লাগবে। তবে, যত দ্রুত উঠছে তার চেয়ে দ্রুত নেমে যাবে।
সারাদেশে শূন্যের কাছাকাছি যেতে কত দিন লাগতে পারে?
বিজন কুমার শীলঃ ঢাকায় পিক আসতে প্রায় চার মাস বা ১৮ সপ্তাহ সময় লেগেছে। নামতে প্রায় ১০ থেকে ১১ সপ্তাহ লাগবে। এটা হয়তো এক এলাকায়। আরেক এলাকায় হয়তো অন্যরকম চিত্র হতে পারে। তাই এটা সমন্বয় করতে পারবেন না। ঠিক যেমন যুক্তরাষ্ট্রে হচ্ছে। সেখানে একটা রাজ্যে হয়ে যাচ্ছে, পরে আরেকটা স্টেটে শুরু হচ্ছে। ওই রাজ্যকে বলতে হবে, কোনটা পিক আর কোনটা অফপিক। ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বাড়তে পারে। ওইসব অঞ্চলও একসময় সর্বোচ্চে পৌঁছবে আবার নেমে আসবে। হার্ড ইমিউনিটি না আসা পর্যন্ত এটা চলতেই থাকবে। সুখবর এটাই যে, যারা এক্সপোজারে (সংক্রমণে) আসছে, কম পরিমাণে লক্ষণ হচ্ছে। অনেকে জানেও না, তার মধ্যে অ্যান্টিবডি এসেছে। এটা একটা ভালো দিক।
এছাড়া আবার কিছু কিছু জায়গায় পিক হবে। সামনে ঈদ আসছে, এ সময় কিছু ভাইরাস ছড়াবে আবার। যেখানে করোনা হয়নি, সেখানে হবে। সবমিলিয়ে পিকে উঠতে যদি ১৮ সপ্তাহ লাগে, নামতেও প্রায় ১৫ সপ্তাহ লাগবে।
বাংলাদেশে সংক্রমণ হলেও রোগীদের মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা কি কম?
বিজন কুমার শীলঃ আমাদের যে আবহাওয়া এই মুহূর্তে বিরাজ করছে, তাতে বাতাসের আদ্রতা বেশি, তাপমাত্রা বেশি- এই দুটো বিষয় ভাইরাসকে সুবিধা করতে দেয় না। ভাইরাস যদি পানির মাধ্যমে ছড়ায় তাহলে সমস্যা হতে পারে। তবে বারবার বৃষ্টি হচ্ছে, আবহাওয়াটা পরিষ্কার হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ভাইরাসটা মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। এটা একটা ভালো দিক।
আর ইউরোপের মানুষের যে বয়স, ওই সময় তাদের যে তাপমাত্রা ছিল, খুব শুষ্ক আবহাওয়া ছিল- এই সবকিছু মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতিকূলে ছিল এবং ভাইরাসের জন্য খুব অনুকূলে ছিল। তাছাড়া ইতালিতে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষের বয়স ছিল ৬০ বছরের উপরে। আর আমাদের দেশে ৬০ বছরের উপরে মাত্র ২০ শতাংশের মতো। এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ। আর আমাদের দেশের মানুষের ইমিউনিটি সিস্টেম (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) খুব অ্যাক্টিভ (সক্রিয়)। সর্বদাই কোনো না কোনো একটা প্যাথলজির সাথে ইন্টারেক্টশন করছে। যে কারণেই হোক ইমিউনিটি সিস্টেম দ্রুত রেসপন্স (সাড়া) করেছে। আপনার ইমিউন সিস্টেম যদি অ্যাক্টিভ থাকে, তাহলে দ্রুত রেসপন্স করে। আর ইমিউন সিস্টেম অ্যাক্টিভ না থাকে, তাহলে রেসপন্স করতে সময় নেয়। এটা একটা ফ্যাক্টর। তাছাড়া আমাদের দেশের মানুষ খোলামেলায় ঘোরাফেরা করে, যেটা ইউরোপে নেই। এগুলো মিলে আসলে আমার মনে হয়, আমাদের জন্য ভাইরাস কিছুটা অনুকূলে রয়েছে। এটা আমাদের জন্য ভালো, সৌভাগ্য। ও রকম মানে দুর্ভোগ আমাদের পোহাতে হয়নি বা মৃত্যুর মিছিল দেখতে হয়নি।
শীতের আবহাওয়া করোনার জন্য ভালো। দেশে আর কয়েক মাস পরেই শীত আসছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
বিজন কুমার শীলঃ আমার মনে হয়, শীতের আগেই পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। মানে ওইরকম হবে না। নির্দিষ্ট এলাকায় থাকতে পারে, যে এলাকায় একেবারে করোনা হয়নি। তবে মোটামুটি মানবসমাজকে বিচ্ছিন্ন করে চলে যাবে করোনা- আমাদের দেশ হোক আর অন্য দেশ হোক। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে একটা রাজ্য থেকে আরেকটা রাজ্য অনেক দূরত্ব। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে তো সময় লেগেছে। ওই জায়গায় সংক্রমণের স্থায়িত্বকাল বেশি হবে। আমরা সেই সমস্যা হবে না, কারণ আমরা খুব কাছাকাছি বাস করি।
/এন এইচ