প্রধান শিরোনামরাজস্বশিল্প-বানিজ্য
রাজস্বের ‘অবাস্তব’ লক্ষ্যমাত্রায় বাড়ছে ঋণের বোঝা
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ মহামারি করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে থমকে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ফলে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে প্রায় অবাস্তব তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে প্রণিত হচ্ছে। তবে খোদ এনবিআরই বলছে, রাজস্বের এ লক্ষ্যমাত্রা কোনোভাবেই অর্জন সম্ভব নয়।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, এমন অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। অতিরিক্ত রাজস্বের চাপে হয়রানিতে পড়বেন করদাতারা। আর সরকারকে ব্যয় মেটাতে অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করতে হবে। অতিরিক্ত সেই ঋণের বোঝা বহন করতে হবে জনগণকে। এভাবে দিনদিন জাতির ঘাড়ে বেড়ে যাচ্ছে ঋণের মাত্রা। তাই আয়-ব্যয়ের যৌক্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের তাগিদ তাদের। তারা আরও বলছেন, করোনার কারণে স্থবির গোটাবিশ্ব। দেশেও প্রায় দুই মাস ধরে চলছে লকডাউন। থমকে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। চলতি অর্থবছর শেষে রাজস্ব আদায় গত অর্থবছরের চেয়ে কমবে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ অনুমান সত্যি হলে দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম আগের অর্থবছরের তুলনায় কম রাজস্ব আহরণ হবে।
করোনার প্রভাবে রাজস্ব আদায় কমে যাওয়া এবং আগামী অর্থবছরে যৌক্তিক হারে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। করোনায় রাজস্ব আহরণের প্রভাব এবং এনবিআরের অবস্থান নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষটি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব বাড়াতে চারটি কৌশল গ্রহণ করেছে সরকর। এগুলো হচ্ছে- আয়কর প্রদানকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রণোদনা প্রদান এবং কাস্টমস ও বন্ডেড ওয়্যারহাউজের সব কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় আনা। এছাড়া ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের নিমিত্তে দ্রুত এবং ব্যাপক ভিত্তিতে ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) যন্ত্র ক্রয়, স্থাপন ও কার্যকর করা। পাশাপাশি আমদানি-রফতানি পণ্য সব পয়েন্টে শতভাগ স্ক্যানিং মেশিনের মাধ্যমে পরীক্ষার কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করা। তবে সরকারের এসব কৌশল ‘পুরোনো ও বস্তাপচা’ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এগুলো তো সব পুরোনা কথাবার্তা। এখন করফাঁকি রোধের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। তাছাড়া করহার বাড়ানো যাবে না এমনকি করোনাকালীন বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন করদাতাও খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।’ ‘ভ্যাট আদায় বাড়াবে বলছে, সেক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য তো বন্ধ। আমদানি-রফতানিতেও ধস, তাই শুল্কও বাড়বে না। কাজেই এসব কথাবার্তা অবাস্তব। রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রাও অবাস্তব।’
এদিকে গত বছরের ২৪ জুলাই অনলাইনে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ে এক লাখ ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি), ৫০০ ইউনিট সেলস ডাটা কন্ট্রোলার (এসডিসি) এবং ফিসক্যাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ইএফডিএমএস) কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। ২৪ জুলাই কমিটির আহ্বায়ক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ সংক্রান্ত একটি ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদনও দেয়া হয়। এসব ইএফডি কিনে গত বছরই এর মাধ্যমে ভ্যাট আদায়ের পরিকল্পনা ছিল অর্থমন্ত্রীর। কিন্তু সেটা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। একইভাবে আমদানি-রফতানি পণ্য সব পয়েন্টে শতভাগ স্ক্যানিংয়ের উদ্যোগও অনেক আগেই গ্রহণ করা হয়। কিন্তু তাও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তাই আগামী বাজেটে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে যৌক্তিক পরিমাণ রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের তাগিদ দেন বিশ্লেষকরা। তারপরও যদি অযৌক্তিক পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয় তাহলে তা কখনই অর্জন করতে পারবে না এনবিআর। ফলশ্রুতিতে সরকারকে বেশি বেশি পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করতে হবে। এতে জাতির ঘাড়ে ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজস্ব আহরণে অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা দেয়া সঠিক নয়। সেটা যখন অর্জন সম্ভব না হয় তখন ম্যাক্রো ইকোনমি ম্যানেজমেন্টেও সমস্যা হয়। রাজস্ব আয় তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণই হচ্ছে এর বিপরীতে সরকার এত টাকা ব্যয় করবে; মূলত এটা ধরেই বাজেট প্রণয়ন। ব্যয়ের বাজেট ঠিক করেই সরকার আয়ের বাজেট করে। ব্যয়ের বাজেট বড় হওয়ায় এনবিআরের টার্গেটও বড় হয়। ব্যয়ের বাজেট বড় হোক— এটা ঠিক আছে। সরকারের ব্যয় মানেই অর্থনীতির আয়। কিন্তু সেজন্য টাকার সংস্থান আছে কি-না, সেটা না দেখে ব্যয়ের বাজেট বাড়ানো ঠিক নয়। এনবিআরকে একটি অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হলো কিন্তু তারা সেটি অর্জন করতে পারল না, তখন ব্যয় মেটাতে সরকারকে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে লোন নিতে হবে। অতিরিক্ত টার্গেট নির্ধারণ করে যখন বাজেট দেয়া হয় তখন সরকারের এ ঋণের পরিমাণ-টাও বেড়ে যায়। আইনগতভাবেও এটা একটা অনিয়ম, অযৌক্তিক। কারণ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করলে অর্থনীতি আরও বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
এছাড়া বাজেট হচ্ছে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া একটি লিখিত দলিল। এতে যা বলা হয় তাই অধিকারে রূপ নেয়। তাই অযৌক্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে অর্থনীতি-কে ঋণগ্রস্ত করে দেয়ার অধিকার দিয়ে দেয়া হয়। মনের মতো একটা লম্বা বাজেট তৈরি করলাম তারপর এনবিআরকে বললাম, এত টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে। এটা বলার মানে হলো এনবিআরের ওপর তা চাপিয়ে দেয়া। রাজস্ব বাড়াতে সরকারের চারটি কৌশলকে ‘বস্তাপচা’ উল্লেখ করে সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, ‘এসব কৌশল অলরেডি তো আছে। কিন্তু কোনো কাজে আসছে না। কেন ইএফডি মেশিন এখনও রেডি করা হয়নি। কেন সব অনলাইন হয়নি— এসব উত্তর তো যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। প্রত্যেক বিভাগকে জবাবদিহিতায় আনতে হবে। এভাবে অযৌক্তি রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে জাতিকে ঋণের দিকে ঠেলে দেয়াটা আইনসম্মতও নয়।’
এদিকে অর্থবিভাগ বলছে, আগামী বাজেটে দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধবাবদ বরাদ্দ বাড়ছে ছয় হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৬৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে ৫৭ হাজার ৬৭ কোটি টাকা, অবশ্য সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয় ৫৭ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যা ছিল ৪৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৪২ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। করোনাভাইরাসের কারণে থমকে যাওয়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রায় পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে এনবিআরকে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হচ্ছে। আগামী ১১ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের কথা রয়েছে।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, পাঁচ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ধরে আগামী বাজেট প্রণয়নের কথা ভাবা হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার কথা চিন্তা করা হয়। করোনার নেতিবাচক প্রভাব সব খাতে পড়ায় শেষপর্যন্ত বাজেটের আকার কম ধরা হচ্ছে।
/এন এইচ