আমদানি-রপ্তানীদেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
রমজান ঘিরে বেড়েছে নানা পণ্যের আমদানি

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক :
রমজান মাস আসতে বাকি আরও মাসখানেক। এই সময়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ইফতারের পাতে শোভা পায় বাহারি রকমের খাবার। যে কারণে অন্যান্য পণ্যের তুলনায় চাহিদা বাড়ে পেঁয়াজ, ডাল (মসুর), খেজুর, ডাবলি (অ্যাংকর), গম, অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের। ক্রেতার চাহিদা মাথায় রেখে রমজানের কয়েক মাস আগেই এসব পণ্য আমদানি শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। সরকার পতনের আন্দোলন, ডলারের রেট বৃদ্ধিসহ নানা সংকটে টালমাটাল পরিস্থিতি ব্যবসায়ীদের। সব বিবেচনায় রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় ১১ পণ্য আমদানি সহজ করতে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ১১ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসির মার্জিন ৩১ মার্চ পর্যন্ত ন্যূনতম পর্যায়ে কমানোর সুযোগ পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এর সুফল দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ডে, সব আশঙ্কা উড়িয়ে দেশে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানিতে গতি সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ২০ লাখ টনের বেশি পণ্য নিয়ে জাহাজ ভাসছে। আসছে আরও পণ্য। বিগত ছয় মাসের হিসাবে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমদানি বেড়েছে। ব্যবসায়ীরাও বলছেন, সরবরাহ নিয়ে সমস্যা হবে না। বিশ্ববাজারে অস্থিতিশীলতা নেই। চিন্তার বিষয় হলো মার্কিন ডলারের দাম। ডলারের দাম বাড়লে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানি ও সরবরাহ পরিস্থিতি ঠিক থাকলেও স্থানীয় বাজারে কারসাজির কারণে অনেক সময় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তাই প্রতিটি পর্যায়ে নজরদারি দরকার। অতীতে দেখা গেছে, যান্ত্রিক ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। বাজারে দাম বেড়ে যায়। সরকার ভোজ্যতেল, চিনিসহ কয়েকটি পণ্যে যে শুল্কছাড় দিয়েছে, তা যেন সাধারণ মানুষ পায়, সেটা নিশ্চিত করার তাগিদও দিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৮৮১ টন। অ্যাংকর এসেছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৭৯১ টন, ছোলা ২৪ হাজার ৬৩২ ও মসুর ডাল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৭৭১ টন। এ ছাড়া সর্বশেষ তিন মাসে খেজুর ২৩ হাজার ১৭০ টন, গম ১১ লাখ ২৬ হাজার ৯৯২, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৫৯, পাম অয়েল ৪ লাখ ৮ হাজার ৪৭২ ও অপরিশোধিত চিনি ৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৬০ টন আমদানি করা হয়েছে।
কাস্টমসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় ৪১ হাজার ৮৪০ টন পেঁয়াজ বেশি আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার অ্যাংকর ১ লাখ ৪১ হাজার ৭৮১ টন, মসুর ডাল ১৪ হাজার ৩৯১, খেজুর ১৪ হাজার ৮৭৯, গম ২৮ হাজার ২০১ ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ১ লাখ ৮ হাজার ৮৬৮ টন বেশি আমদানি হয়েছে। কেবল ছোলা, চিনি ও পাম অয়েল আমদানি আগের বছরের তুলনায় কম হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য নিয়ে দেখা যায়, ছোলার আমদানি শুরু হয়েছে। এ বছরের ১-১১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে প্রায় ৪০ হাজার টন ছোলা আমদানি হয়েছে। মটর ডাল আমদানি হয়েছে ৫৬ হাজার টন। মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ১৩ হাজার টন। ভোজ্যতেল পাম ও সয়াবিন আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার টন। অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ৪৩ হাজার টন।
ভোজ্যতেল, গম, ছোলা, মসুর ও মটর ডালের মতো পণ্য আমদানি ও প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করে টি কে গ্রুপ। জানতে চাইলে গ্রুপটির পরিচালক শফিউল আতহার বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ছোলার দাম বাড়তি থাকলেও আমদানি পর্যাপ্ত পরিমাণে হবে। ভোজ্যতেল, মসুর, মটর ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট হবে না। এ মুহূর্তে বিশ্ববাজারেও কোনো পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা নেই। তিনি বলেন, পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির একমাত্র কারণ হতে পারে ডলারের দাম। ডলারের দাম বেড়ে গেলে পণ্যের আমদানি খরচ বাড়বে। তেমনি বাড়বে শুল্ককরের পরিমাণও।
সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘রোজা ছাড়াও ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতার প্রয়োজনে সংকটের মধ্যেও পণ্য আমদানি অব্যাহত রাখা হয়েছে। ফলে প্রতিবারের মতো এবারও রোজার পণ্য নিয়ে সংকটের কোনো সুযোগ নেই। পণ্যের মূল্যের কারণে অবশ্য ভোক্তা পর্যায়ে আগের তুলনায় চাহিদা কমেছে।’
চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় খাদ্যশস্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘রোজার কয়েক মাস আগেই পণ্য আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। এবার মোট চাহিদা, আমদানি ও মজুত নিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে কোনো সঠিক তথ্য না থাকায় অনেক সময় চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পণ্য আমদানি হয়ে যায়। আমদানি প্রক্রিয়ায় নানামুখী সংকট থাকলেও মানুষের ভোগপ্রবণতা ঋণাত্মক হওয়ায় এবারের রোজায় নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে অস্থিরতা না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে চাল আমদানির সুযোগ ও শুল্ক কমানো হলেও পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। চাল আমদানি ততটা বাড়ছে না। ভরা মৌসুমেও বাজারে চালের দাম বাড়ছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি চার টাকা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ঋণপত্র খোলা মানেই আমদানি নয়। ঋণপত্রের বিপরীতে পণ্য শেষ পর্যন্ত আমদানি হয় কি না, সেদিকে নজর রাখতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজারে গুটিকয় বড় ব্যবসায়ী বেশি আমদানি ও সরবরাহ করেন। তাদের কারও সরবরাহে বিঘ্ন হলেই বাজারে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা থাকে। সেদিকেও দৈনিক ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ দরকার। গত বছরের তুলনায় এবার ডলারের দাম বেশি এবং বিশ্ববাজার চড়া। ফলে পণ্যের আমদানি ব্যয় কিছুটা বেশি পড়বে। অন্য কোনো কারণে যাতে দাম না বাড়ে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ছোলা আমদানি হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে। পাশাপাশি রাশিয়া, ইউক্রেন, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, কানাডা, ভারত, মিয়ানমার ও তানজানিয়া থেকেও ছোলা আমদানি করে আসছেন আমদানিকারকরা। প্রতিবছর ছোলার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৮০ হাজার টন। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে ছোলা আমদানি হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার টন। অথচ তার আগের বছর এই সময়ে আমদানি হয়েছিল মাত্র ৯ হাজার টন। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়েক মাস ধরে ছোলার দাম কম ছিল। এটির সুযোগ নিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। এ জন্য শুধু ডিসেম্বরেই ছোলা এসেছে ১৫ হাজার ৫৮৭ টন। ১ থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এসেছে প্রায় ৪৫ হাজার টন।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের কিছু ব্যবসায়ী চিনি আনছেন নতুন দেশ থেকে। এতে সরবরাহ বেড়েছে। আবার দামেও বৈচিত্র্য এসেছে। খাতুনগঞ্জে এখন ব্রাজিল, জার্মানি, ভারত ও পাকিস্তান থেকে আসা চিনি বিক্রি হচ্ছে। পাইপলাইনে আছে এসব দেশের আরও চিনির চালান। বৈধ চ্যানেলের পাশাপাশি অবৈধ পথেও কিছু চিনি আসছে ভারত থেকে। নানা দেশ থেকে চিনি আসতে থাকায় গত মাসের চেয়ে চিনির দাম মণপ্রতি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কমেছে। খাতুনগঞ্জের বাজারে এখন প্রতি মণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ২০০ টাকায়। ডিসেম্বরের আগে যা বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ২৫০ টাকায়।