স্বাস্থ্য
যে কারণে শিশুরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে না
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৭৭৫ জনে দাঁড়িয়েছে।
শুধু রোববারই দেশটিতে মারা গেছে ১০৫ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে।
তবে এমন মৃত্যুর মিছিলে সুখের সংবাদ হলো- এসব আক্রান্তদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা খুবই কম। আর শিশুদের মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে না তেমন।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি জন্মের মাত্র ৩০ ঘণ্টা পর এক নবজাতকের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেয়ার খবর প্রচারিত হয় আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায়।
এরপর আর কভিড-১৯ এ কোনো শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে খবর জানা যায়নি।
অথচ নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃতদের তালিকায় বড় সংখ্যায় শিশুদের থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা এর রহস্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে সর্বশেষ গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্রের মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের আঁতুড়ঘর উহানের জিনইনতান হাসপাতালের রোগীদের নিয়ে বিশ্লেষণ করে বিশেষ কিছু তথ্য পেয়েছেন গবেষকরা।
ওই বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকেরই বয়স ৪০ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে। ৩৯ বছরের কম বয়সী রোগী অনুপাত মাত্র ১০ শতাংশ। আর ১৮ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে ভাইরাসটির সংক্রমণের ঘটনা বিরল।
এমন পরিসংখ্যানে প্রশ্ন উঠেছে, ‘ভাইরাসটি শিশুর শরীরে সংক্রমিত হচ্ছে না কেন? এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক ধরনের তত্ত্ব সামনে রাখলেও এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব নেই।’
এ বিষয়ে ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ইয়ান জোনস বিবিসিকে বলেন, ‘এমন প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব এখনো দিতে পারছি না আমরা। এখন পর্যন্ত আমাদের বলতে হচ্ছে -হয় শিশুরা সংক্রমণ এড়িয়ে যাচ্ছে, নয়তো তারা মারাত্মক সংক্রমণের শিকার হচ্ছে না।’
তাই বলে করোনাভাইরামের সংক্রমণ থেকে শিশুরা মুক্ত সঠিক নয় বলেন জানান ইয়ান জোনস।
তিনি বলেন, ‘শিশুরা এ ভাইরাসে মৃদুভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে তাদের মধ্যে সেভাবে রোগের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। তারা মারাও যাচ্ছে না। চিকিৎসকের কাছেও যেতে হচ্ছে না তাদের। আর গেলেও হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার হয় না। ফলে পরিসংখ্যানে তাদের সংখ্যা স্থান পায়নি।’
অধ্যাপক ইয়ানের বক্তব্যের সহমত জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ক্লিনিক্যাল প্রভাষক নাথালি ম্যাকডারমট।
তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কভিড-১৯ নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষার ফলাফলে আমরা দেখেছি, ভাইরাসটির মোকাবেলায় পাঁচ বছরের বেশি বয়সী শিশু-কিশোরদের দেহ বেশ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন। ভাইরাসটি তাদের শরীরে সেভাবে কাজ করতে পারে না। এ কারণে সেসব শিশু আক্রান্ত হলেও সংক্রমণর কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। অনেক শিশুর অভিভাবক হয়তো টেরই পান না যে, তাদের সন্তান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।’
এছাড়াও অন্য একটি বিষয় তুলে আনেন ম্যাকডারমট। ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া মুহূর্তে চীনে শিশুদের নববর্ষের ছুটি থাকায় তারা কম সংক্রমিত হয়েছে বলেও মত দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘প্রাদুর্ভাব শুরুর সময় চীনের নতুন বছরের ছুটি চলছিল। এ সময় উহানসহ চীনের সব প্রদেশে স্কুলগুলো বন্ধ ছিল। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিয়ে অনেক স্কুল ছুটিও দিয়েছিল। যেকারণে এসব শিক্ষার্থীরা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেনি।’
স্কুল খোলা থাকলে শিশুদের মধ্যেও রোগ বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ত বলে ধারণা করেছেন তিনি।
ম্যাকডারমটের এমন অভিমতের পরেও প্রশ্ন থেকেই যায়। তাহলো, বর্তমানে আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেলেও সেই হারে শিশুদের আক্রান্তের ঘটনা বাড়েনি।
ম্যাকডারমটের স্কুল তত্ত্বকে নাকোচ করে দিয়ে কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির একজন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু ফ্রিডম্যান বিবিসিকে বলেন, ‘হতে পারে কভিড-১৯ এর সংক্রমণ শিশুদের তুলনায় প্রাপ্তবয়স্কদের মারাত্মকভাবে সংক্রমিত করে।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘জলবসন্তের জীবাণুতে শিশুদের চেয়ে বড়দের বেশি আক্রান্ত করে।’
অ্যান্ড্রু ফ্রিডম্যান আরো বলেন, ‘শিশুদের হয়তো কোনোভাবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, যা আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়।’
অ্যান্ড্রু ফ্রিডম্যানের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের স্ট্যাটিস্টিকাল এপিডেমিওলজির বিশেষজ্ঞ ক্রিসেল ডনেলি।
তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালে চীনে সার্স ও ২০০৭ সালে হংকংয়ে মার্স ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময়েও একই ঘটনা দেখা গেছে।’
তিনি তথ্য দেন, ‘সার্স ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময় ৮০০ মানুষ মারা গেলেও শিশুদের সংক্রমণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কম ছিল এবং মার্স এর সময় ১৩৫ জন শিশু আক্রান্ত হয়। কিন্তু সে প্রকোটে কোনো শিশু ও কিশোরের মারা যাওয়ারা খবর পাওয়া যায়নি।’
শিশুদের দেহে সার্স ও মার্সের মতো করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও একই বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে জানান ডনেলি।
এসব বিশ্লেষণ শেষে বিজ্ঞানীরা একমত যে, চলতি প্রাদুর্ভাব নিয়ে আরো বেশি গবেষণার পর হয়তো এ বিষয়ে একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে।
/আরএম