শিক্ষা-সাহিত্য

‘মিষ্টির তিক্ততার পেছনে গবি প্রশাসনের হাত’

গবি প্রতিনিধিঃ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে টানা ৬৮দিন ক্লাস, পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলন করেছিল সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এ আন্দোলনের এক পর্যায়ে আন্দোলন সফল হয়েছে এমন ঘোষণা আসে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে। কিন্তু এ ঘোষণার পরে বুধবার (৩১ জুলাই) পর্যন্ত ৪৮ দিনে কোন কার্যকরী বা আশানুরূপ ফলাফল পায়নি বলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সূত্রে জানা যায়। এ নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সাধারণ ছাত্র পরিষদের প্রতি ক্ষোভও প্রকাশ করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, কোনো আশানুরূপ ফল ছাড়াই চলমান আন্দোলন স্থগিত করে মিষ্টি খেয়ে ক্লাসে ফিরি আমরা। প্রত্যাশা ছিল আমাদের বৈধ ভিসি আসবে কিন্তু সেই আশা এখন দূরাশায় পরিনত হয়েছে। তাহলে এই মিষ্টি বিতরণ এবং বিজয় উৎসব কি শুধুই প্রহসন ছিল?

চলতি বছরের ১৩ জুন (বৃহস্পতিবার) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক লাইভে এসে ক্লাস, পরীক্ষায় ফেরার ঘোষণা দেন গবি সাধারণ ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক রনি আহমেদ। তিনি ফেসবুক লাইভে সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ। আমরা যে ভিসি আন্দোলনে ছিলাম, আপনাদের সহযোগীতায়, আপনাদের অংশগ্রহণে আমরা সাক্সেসফুল। আমরা আজকে সাক্সেসফুল। কালকে (১২জুন ২০১৯) আমাদের শিক্ষক ও প্রশাসন আমাদের মৌখিকভাবে জানিয়েছিল আমরা ভিসি নিয়োগের চূড়ান্ত পর্যায়ে। কিন্তু আমাদের আজকে (১৩ জুন) তারা লিখিতভাবে এবং প্রমাণাদিসহ দেখাইতে সক্ষম হয়েছে আমাদের ভিসি নিয়োগ অলমোস্ট চূড়ান্ত। ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটি ফাইল তিনটি দপ্তরের(ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) মোট ১৩টি টেবিল ঘুরে প্রক্রিয়া শেষ হয়। আমাদের ফাইলটি ইতমধ্যে আটটি টেবিল পাড় করে নয় (০৯) নাম্বার টেবিলে অবস্থান করছে।”
তিনি আরও বলেন, “এখন আমাদের ৯৮% কাজ সম্পন্ন। আমরা ভিসি পাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ লায়লা পারভিন বানু ম্যামই ভিসি হয়ে আমাদের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। আন্দোলন আজকে সফল, আমরা আজকে সাকসেসফুল। আমরা আজকে মিটিং এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা শনিবার (১৫জুন) থেকে আমরা নিয়মিত ক্লাস শুরু করে দিব। আমাদের পক্ষ থেকে সকলের উদ্দেশ্যে আমরা বিবৃতি দিয়েছিলাম যে, আমরা ভিসি আসার ঠিক ২১ দিন পর আমরা ক্লাসে যাব। কিন্তু ভিসি নিয়োগ যেহেতু কনফার্ম সেহেতু এখন ক্লাস বন্ধ করে বসে থাকা আমাদের জন্য বোকামি, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। আন্দোলনের সকল ব্যর্থতা সাধারণ ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ থেকে মাথা পেতে নিলাম, আর সকল সফলতা সকল শিক্ষার্থীদের জন্য উৎসর্গ করলাম।”

এদিন সাধারণ ছাত্র পরিষদের সমন্বয়ক শেখ খোদার নূর রনি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে জানান, “আগামী শনিবার (১৫জুন) গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজয় উৎসব পালন করা হবে। আমাদের দীর্ঘ ৬৮ দিনের লাগাতার ভিসি আন্দোলন সফল হয়েছে। ভিসি নিয়োগ চূড়ান্ত হয়ে গেছে।”

এছাড়াও এ সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবুর রহমান রনি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে আরও জানান, “আমরা আন্দোলনে ৯৮ ভাগ সফলতা পেয়েছি।” পরে ১৫জুন (শনিবার) শিক্ষার্থীরা একে অপরকে মিষ্টি খাওয়ানোর মাধ্যমে বিজয় উৎযাপন করে সাধারণ ছাত্র পরিষদ।
এই উৎসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. দেলোয়ার হোসেন ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মীর মূর্ত্তজা আলী বাবু সহ বেশ কয়েকজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী শামিল হন। উৎসবে তারা শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করে সেমিষ্টার ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বলেন। মিষ্টি বিতরণ উৎসবে রেজিস্ট্রার দেলোয়ার হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে প্রায় ৩০০০ টাকা খরচ করে শিক্ষার্থীদের ২০ কেজি মিষ্টি কিনে খাওয়ান। মিষ্টি কেনা এবং বিতরণ করা সহ কথিত ‘বিজয় উৎসবের’ দায়িত্ব পালন করে গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ ছাত্র পরিষদ।

ছাত্র পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবুর রহমান রনি সাংবাদিকদের কাছে মিষ্টি বিতরণের পেছনে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অবদানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এই বিষয়ে ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “প্রশাসনের টাকায় ছাত্র পরিষদ মিষ্টি বিতরণ ও বিজয় উৎসব করলো। কিন্তু তাদের আশ্বাসের পরে ৪৮দিন পেরিয়েও আমরা উপাচার্য বিষয়ে কোন আশানুরূপ সমাধান পাইনি। তবে কেন এমন প্রহসন? কেন আন্দোলনে কোনো সফলতা ছাড়া কেন মিষ্টি খেয়ে ক্লাসে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ?

মিষ্টি খাওয়ার পর ঘটনার ২১ দিন পরে (৪ জুলাই) সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষায় বসে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, “আন্দোলনে কোন সফলতা আসেনি। তারপরেও কেন সাধারণ ছাত্র পরিষদ মিষ্টি বিতরণ করেছে? উপাচার্যের বৈধতা আমরা সবাই চাই, কিন্তু শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয় এ রকম কোন আন্দোলন বা কার্যক্রম আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি না।”

ভেটেরিনারি এণ্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ জানান, “আন্দোলন বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসানো হয়েছিল। আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি দীর্ঘ আন্দোলন ও আশ্বাসের পরে এখন পর্যন্ত উপাচার্য না পাওয়া। ৬৮দিন আন্দোলন করেছি, আরো কিছুদিন আন্দোলন হলে হয়তো সুষ্ঠু কোন সমাধান পেতাম।”

এ প্রসঙ্গে সাধারণ ছাত্র পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবুর রহমান রনি জানান, “আন্দোলনে ব্যর্থতার জন্য রেজিস্ট্রার মোঃ দেলোয়ার হোসেন, সহকারী রেজিস্ট্রার আবু মুহাম্মদ মুকাম্মেল, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের প্রধান মনিরুল হাসান মাসুম ও জৈষ্ঠ্য হিসাব-রক্ষক মো. জাহাঙ্গীর আলম দায়ী। তারা আমাদের ভুল তথ্য দিয়ে আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে। তাদের আশ্বাসে আমরা আন্দোলন স্থগিত করে ক্লাসে ফিরেছি। মিথ্যা আশ্বাসে আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে তারা। কঠিন আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা তার জবাব দেব। খুব শীঘ্রই উপাচার্য বিষয়ে যা করা লাগে তাই করব। আমরা ব্যর্থ হইনি। আমরা আন্দোলন শুধুমাত্র স্থগিত করেছিলাম। প্রয়োজনে আবার আন্দোলন শুরু হবে।”
অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব ও প্রশাসনিক বিভাগের জৈষ্ঠ্য সহকারী পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “তখন দুই মাসেরও অধিক সময়ের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছিলো। ঈদের আগে সেমিষ্টার ফাইনাল পরীক্ষা না হলে তারা অনেক পিছিয়ে পড়তো। আর এমনিতেও তখন উপাচার্য নিয়োগের ফাইল অনেক দূর এগিয়ে ছিল। এজন্যই উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতি বিবেচনা ও শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে আমরা শিক্ষার্থীদের অতি শীঘ্রই সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দেই।”

তবে আন্দোলন স্থগিতের ৪৮ দিন অতিবাহত হওয়ার পর সেদিনের মিষ্টি খাওয়ার স্মৃতি শিক্ষার্থীদের কাছে এখন তিক্ততায় পরিনত হয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close