দেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
মাত্র ২০ মিনিটে গাজীপুর-এয়ারপোর্ট, কাজ প্রায় অর্ধেক শেষ
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে গাজীপুরের সড়ক যোগাযোগ দ্রুত ও সহজ করতে চৌরাস্তা থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত বাস র্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) নির্মাণ কাজ প্রায় অর্ধেক সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট আসতে সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিট।
চার বছরে অর্থাৎ ২০১৬ সালে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তিন দফায় সময় বাড়িয়ে এখন তা করা হয়েছে ২০২২ সাল পর্যন্ত। দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে সাড়ে ৭ বছরে সেটির কাজ হয়েছে প্রায় অর্ধেক বা ৪৩ শতাংশ। খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। তিন দফায় সময় বাড়িয়েও লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় অর্ধেক পিছিয়ে আছে প্রকল্পটি। তবে তৃতীয় মেয়াদের নিদিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রকল্প শেষ হবে বলে আশা প্রকল্প পরিচালকের।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ট্রান্সপোর্ট পদ্ধতিকে আধুনিক ও সমন্বিত করার প্রয়াসে ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রণীত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি-২০০৫) সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কর্তৃক নগর পরিবহন বিষয়ক কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে যাচাইয়ের জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। ২০১১ সালে এডিবি সমীক্ষা করে। এই সমীক্ষা জরিপে গাজীপুর-টঙ্গী-বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটি সড়ক নির্মাণ সম্ভব বলে বিবেচিত হয়।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক সহযোগিতায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লাইন-৩ গাজীপুর থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার বাস র্যাপিড ট্রানজিট নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে গাজীপুর থেকে টঙ্গী হয়ে উত্তরাসহ রাজধানীর সঙ্গে দ্রুত, নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থায় ঘণ্টায় ৪০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবে। বিআরটি বাস থাকবে ১৪০টি। গাজীপুর-এয়ারপোর্ট পর্যন্ত মোট স্টেশন থাকবে ২৫টি।
সরকার ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর একনেক সভায় গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) অনুমোদন দেয়। দুই হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করতে সময় বেঁধে দেয়া হয়।
ডিপিপির প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্প মেয়াদ পরিবর্তন না করে শুধু প্রকল্প সাহায্য ও স্থানীয় মুদ্রার সমন্বয় করা হয়। তবে প্রকল্প ব্যয়ের কোনো সংশোধনী করা হয়নি। এরপর ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারিতে মেয়াদ ২ বছর বাড়ানো হয়।
২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়। এখানে প্রকল্প সহায়তা ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত নেয়া হয়।
অর্থায়নকারী সংস্থা হলো, এডিবি, ফরাসী উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি), গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (ডিইএফ)। দুঃখজনক হলো প্রকল্প সাহায্য বৃদ্ধি পেলেও অতিরিক্ত এক হাজার ৩১৬ কোটি ১১ লাখ টাকা বৈদেশিক সাহায্যের অর্থ এখনো পর্যন্ত প্রদান করা হয়নি।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দুই দফা সময় বাড়িয়েও লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় অর্ধেক পিছিয়ে থাকায় প্রকল্পটির চুক্তি সিও-১ শেষ করার জন্য ২০২১ সালের জানুয়ারি এবং চুক্তি সিও-২ এর কাজ শেষ করার জন্য ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানোর জন্য বলেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। আর প্রকল্প পরিচালক প্রকল্পটি সমাপ্তির জন্য ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সময় চেয়েছে বলেও জানা গেছে।
প্রকল্পের বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, দ্বিতীয় সংশোধনীতে ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় ৬৬ কোটি ৪৮ লাখ থেকে ২২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও ক্ষতিপূরণ ব্যয় ১৫৬ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিমানবন্দরে ভুগর্ভস্থ পথচারী টানেল নির্মাণে ৪২০ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়।
এ ছাড়া ভৌত অবকাঠামোর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, প্রাক্কলন প্রস্তুতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) ২০১৫ সালের রেট শিডিউল ব্যবহারের কারণে ১০৯ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে।
এই প্রকল্পের প্রধান কাজ হচ্ছে ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পেইন করিডোর নির্মাণ। যার ১৬ কিলোমিটার এ্যাট গ্রেড, সাড়ে ৪ কিলোমিটার অ্যালিভেটেড।
এছাড়া বিআরটি বাস ডিপোসহ বিভিন্ন স্থানে স্টপেজ নির্মাণ করা। পাশাপাশি মেইন করিডোর সংলগ্ন ১১৩টি বা ৫৬ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের উন্নয়ন। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ড্রেন নির্মাণ ও ১০টি কাঁচাবাজার নির্মাণ। রয়েছে আর্টিকুলেটেড বাস ক্রয়।
২০২০ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি সরেজমিন দেখা যায়, প্যাকেজ-১ এ ৬টি ফ্লাইওভারসহ ১৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ৪৩ শতাংশ, যা ২০২০ সালে ১৯ জুন সমাপ্ত করার কথা ছিলো। প্যাকেজ-২ এর আওতায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার অ্যালিভেটেড বাস লাইন নির্মাণ কাজ হয়েছে মাত্র ২৯.২০ শতাংশ, যা ২০২০ সালের ১৮ জুন শেষ করার কথা। প্যাকেজ-৩ এর আওতায় ১১৩টি সংযোগ সড়ক উন্নয়ন ও ১০টি কাঁচাবাজার নির্মাণ, যা ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। আর প্যাকেজ-৪ এর আওতায় গাজীপুরে একটি বিআরটি ডিপো নির্মাণ, সেটিও ২০১৯ সালে শেষ হয়েছে।
জানতে চাইলে সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বলছে, প্রকল্প এলাকায় রাস্তার পাশে ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টিসহ দৈনন্দিন ব্যবহারের পানি জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। এতে নির্মাণকাজে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান স্ট্যাক ইয়ার্ডের যথেষ্ট জায়গা না পাওয়ায় পূর্ত কাজের দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়েছে। আর বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণেই প্রকল্পের খরচ বাড়ছে। বিগত চার বছরে তিনবার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে। ফলে নতুন পিডিকে কাজ বুঝতে সময় লেগেছে বলেও জানান তারা।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক চন্দ্রকুমার বসাই বলেন, জনগণের দুর্ভোগ কমাতে যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্প শেষের চেষ্টা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি তৃতীয় মেয়াদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের সম্পন্ন কাজ সমাপ্ত হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রকল্পের ধীরগতি বা সময়মতো শেষ না হওয়ার প্রসঙ্গে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার তাগিদ দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
গত সোমবার সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তা এবং দফতর প্রধানদের সঙ্গে উন্নয়ন কার্যক্রম পর্যালোচনা সভায় তিনি এ তাগিদ দেন।
মন্ত্রী বলেন, ব্যয় বাড়ানোর জন্য প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদারদের যোগসাজসে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা নষ্ট ও অর্থের অপচয় হয়। পাশাপাশি মধ্য মেয়াদি বাজেট পরিকল্পনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি বলেন, অনেক প্রকল্পের ধীরগতি বা সময়মতো শেষ না হওয়ার জন্য ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্বের সত্যতা অনেক জায়গায় পাওয়া গেছে। আবার প্রকল্প পরিচালকদের মধ্যেও সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা যায়।
এ বিষয়ে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সড়কের কাজের গুণগত মানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। কাজের মানের বিষয়ে ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা দায় এড়াতে পারবেন না। যারা মনিটরিং করবেন তাদেরও দায় নিতে হবে।
/এন এইচ