দেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
ভুয়া চালকে চলছে ৩৮% ভারী যান
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: ভারী যানবাহন দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তায় চলে। এ জন্য যানবাহনের তুলনায় চালকের সংখ্যা বেশি থাকা জরুরি। অথচ দেশের প্রায় ৩৮ শতাংশের বেশি ভারী যানবাহনের চালকের কোনো লাইসেন্স নেই।
মোটরযান আইনে ভারী যানবাহনের মধ্যে পড়ে—বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, বিশেষ যানবাহন (লরি, মিক্সচার মেশিনবাহী যান)। আর হালকা যানবাহন হচ্ছে—মোটরগাড়ি, ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস, হিউম্যান হলার, অ্যাম্বুলেন্স, পিকআপ, জিপ ইত্যাদি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে ভারী যানবাহন আছে ২ লাখ ৫২ হাজার। এসব যানবাহনের বিপরীতে বৈধ লাইসেন্স আছে এমন চালকের সংখ্যা ১ লাখ ৫৫ হাজার। অর্থাৎ ৩৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ যানবাহন চলছে ভুয়া চালক দিয়ে। আর দেশে হালকা যানবাহনের সংখ্যা ৭ লাখের কিছু বেশি। এই শ্রেণির যানবাহনের চালকের লাইসেন্স আছে ১৭ লাখের ওপরে। অর্থাৎ যানবাহনের তুলনায় চালকের লাইসেন্স আড়াই গুণ। সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ ভারী যানবাহনের বেপরোয়া গতি।
মোটরযান আইন অনুসারে, একজন চালক একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি ভারী যানবাহন চালাতে পারবেন না। আধঘণ্টার বিরতি দিয়ে পুনরায় চালাতে পারবেন। তবে দিনে ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি চালাতে দেওয়া যাবে না। আর এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব যানবাহনের মালিকের।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও মালিক শ্রমিক সংগঠনের সূত্র বলছে, ভারী যানবাহনের মালিকদের একটি বড় অংশই ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মী। মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলোও নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন নেতারা। যেমন বাসমালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান। তিনি জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী। সংগঠনটির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দক্ষিণ শাখার সহসভাপতি।শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি হলেন আওয়ামী লীগের সাংসদ ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
চালক দরকার আড়াই থেকে তিন গুণ
ভারী যানবাহন বাণিজ্যিক শ্রেণির। এসব যানবাহনের জন্য পেশাদার চালক হতে হয়। মোটরযান আইন অনুসারে, ভারী যানবাহনের চালকের সর্বনিম্ন বয়সসীমা ২১ বছর। আর হালকা যানের চালকের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। একজন হালকা যানের চালক তিন বছর পর মাঝারি যানের লাইসেন্স পেতে পারেন। মাঝারি যান চালানোর তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেই কেবল ভারী যানের চালক হতে পারবেন। পেশাদার চালককে পাঁচ বছর পরপর পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। অর্থাৎ হালকা যানবাহনের তুলনায় ভারী যানের চালক হওয়ার প্রক্রিয়া কঠিন। কারণ, ভারী যানবাহন দূরের পথে চলে। কিছু কিছু ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান টানা দু-তিন দিনও রাস্তায় থাকে। মোটরযান আইন মেনে এবং দূরের যাত্রার কথা বিবেচনায় নিলে যানবাহনের তুলনায় চালক আড়াই থেকে তিন গুণ থাকা জরুরি।
এ বিষয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চালকের সংকট আছে, এটা সত্য। এ জন্য তাঁরা হালকা থেকে মাঝারি এবং মাঝারি থেকে ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্সের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য এক বছরের অভিজ্ঞতা বেঁধে দিয়েছেন। অর্থাৎ যাঁর হালকা লাইসেন্স আছে, তিনি দুই বছরেই পরীক্ষায় পাস করে ভারী যানের লাইসেন্স পেতে পারেন। তবে এই সুযোগ দেওয়ার পরও চালকেরা কম আসছেন। পেশাদার চালকের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া এবং তাঁদের প্রশিক্ষণের জন্য বিআরটিএ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
দূরপাল্লা ও রাজধানীর পথে বাস-ট্রাক চালান এমন পাঁচজন চালকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এর মধ্যে দুজনের বৈধ লাইসেন্স আছে বলে জানান। একজনের লাইসেন্স আছে, তবে নবায়ন করেননি। বাকি দুজনের লাইসেন্স নেই। এসব চালক জানান, ভারী যানবাহনের চালকদের প্রায় শতভাগই প্রথমে চালকের সহকারী বা কন্ডাক্টর ছিলেন। তাঁরা ‘ওস্তাদের’ কাছ থেকেই গাড়ি চালানো শিখেছেন। তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। সড়কের সাইন-সংকেত সম্পর্কেও কোনো প্রশিক্ষণ নেই। তাঁদের কাছে লাইসেন্স পরীক্ষা দিতে যাওয়া মানেই একটা ঝক্কি, দালালের খপ্পরে পড়ে বাড়তি গচ্চা দেওয়া। এ ছাড়া একাধিক দিন বিআরটিএ কার্যালয়ে যাওয়ার কারণে আয় থেকেও বঞ্চিত হতে হয়। ১৯৯০ সালের পর বিভিন্ন সময় সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দেওয়া তালিকা ধরে পেশাদার চালকদের লাইসেন্স সংগ্রহ ও নবায়ন হয়েছে। কিন্তু আদালতের রায়ে তা এখন সম্ভব হচ্ছে না।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী প্রথম আলোকে বলেন, যেসব চালক ভারী যানবাহন চালাতে পারেন, তাঁদের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি সহজ করা উচিত। বিআরটিএতে গেলেই চালকেরা চক্করে পড়ে যান। এ জন্যই যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্স কম। অনেকে বছরের পর বছর লাইসেন্স নবায়ন করেন না। রাস্তায় পুলিশ ধরে, মামলা দেয়, চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। ব্যবস্থা পরিবর্তন না করে শুধু চালকদের দোষ দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।
দেশে ভারী যানবাহন আছে ২ লাখ ৫২ হাজার
বৈধ চালকের লাইসেন্স ১ লাখ ৫৫ হাজার
প্রতিটি ভারী যানের বিপরীতে চালক থাকা দরকার তিনজন
চালক আছেন একজনের কম
৯০% দুর্ঘটনার পেছনে চালক কোনো না কোনোভাবে দায়ী
৫৩% সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি
বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের মতো বাণিজ্যিক যানবাহনের মালিক ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারী যানবাহনের চালকের সংকটের কারণে আট ঘণ্টার বেশি যানবাহন চালাতে না দেওয়ার যে আইনি বাধ্যবাধকতা আছে, তা মানা হয় না। প্রতি পাঁচ ঘণ্টা পর বিশ্রামের যে বিধান, তা–ও কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ। নামীদামি কিছু কোম্পানি চালকদের বিশ্রাম দিলেও অনেক চালক অন্য মালিকের যানবাহন চালাতে নেমে পড়েন। সংকটের কারণে যানবাহনের মালিক লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে নিজের যান তুলে দেন। কম মজুরিতে চালক পেতে অনেকে হালকা যানের চালক দিয়ে ভারী যান পরিচালনা করেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, এখন দেশে কোটি টাকার বেশি দামি প্রচুর বাস চলছে। চালকের সংকটের কারণে ভুল করলেও তাঁদের কিছু বলা যায় না। চাপ দিলে চাকরি ছেড়ে অন্য মালিকের গাড়ি চালানো শুরু করেন।
দুর্ঘটনার বড় কারণ বেপরোয়া গতি
দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমছেই না। এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বেপরোয়া যান চালনা। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের মার্চে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে দূরপাল্লার চালকদের জন্য মহাসড়কে বিশ্রামাগার নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পাশাপাশি চালকদের আট ঘণ্টার বেশি যান চালাতে না দেওয়ার নির্দেশনা দেন। এরপর সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) মহাসড়কের পাশে চালকদের জন্য কিছু বিশ্রামাগার নির্মাণের একটি প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু নতুন পেশাদার চালক তৈরি হচ্ছে না।
১৯৯৯ সাল থেকে সড়ক দুর্ঘটনার পুলিশের দেওয়া তথ্য সংরক্ষণ এবং তা বিশ্লেষণ করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। সংস্থাটির ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্লেষণ বলছে, ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার পেছনে চালক কোনো না কোনোভাবে দায়ী। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব বলছে, ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ২৯ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান জড়িত। আর প্রায় ১৯ শতাংশ ঘটেছে বাস-মিনিবাসের কারণে। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনার ৪৮ শতাংশের সঙ্গেই বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান জড়িত।
এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, হালকা যান রাতে কম চলে, চালকের ভূমিকা অনেকটাই চাকরির মতো। অন্যদিকে ভারী যান দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই চলে। ফলে যানবাহনের তুলনায় কমপক্ষে আড়াই গুণ চালক থাকা উচিত। বাংলাদেশে যেসব চালক আছেন, তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। টানা কাজ করেন। আবার ক্ষেত্রবিশেষে মালিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেন। সব মিলিয়ে একজন চালককে বেপরোয়া হওয়ার জন্য যা যা দরকার, তার সবই করে দেওয়া হয়েছে। ফলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে। তিনি বলেন, বিআরটিএ চালকের লাইসেন্স ও যানবাহনের নিবন্ধন দেয়। চালকের তুলনায় যান বেশি হলে এগুলো কে চালাবে, এটা কি সংস্থাটি ভেবেছে কখনো? দুর্ঘটনার দায় তাদের ওপরও বর্তায়।
#সুত্র-প্রথম আলো#