দেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
ভাসানচরের আধুনিকতা দেখে মুগ্ধ রোহিঙ্গারা, যেতেও প্রস্তুত
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ মিয়ানমারে থাকা অবস্থায় প্রতিনিয়ত থাকতেন আতঙ্কে। নিপীড়ন-নির্যাতনে কেটেছে কয়েক যুগ। তারপরও মেলেনি কোনো স্বস্তি। অবশেষে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর লাগাতার নির্যাতনে নিজ দেশও ছাড়তে হলেন রোহিঙ্গারা। ঠাঁই হলো তাদের কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে।
সেখানেও নানা চরাই-উৎরায়ে তাদের কেটে গেছে কয়েক বছর। কিন্তু মিলছে না কোনো স্বস্তির ঠিকানা। এমন অবস্থায় সেই রোহিঙ্গাদের কথা চিন্তা করেই বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। এরই অংশ হিসেবে নোয়াখালীর ভাসানচরে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে একটি আধুনিক শহর। এরইমধ্যে সেই শহরের সুখবর পৌঁছে গেছে রোহিঙ্গাদের কাছে। আধুনিক নাগরিকের সব প্রকার সুযোগ সুবিধা সম্বলিত এ শহরটিতে যেতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেছেন রোহিঙ্গারা।
ভাসানচরে এখন সারি সারি সুদৃশ্য ঘর। এই চরে এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে স্থানান্তর করতে চায় বাংলাদেশ সরকার। সে লক্ষ্যে আবাসন, সাইক্লোন শেল্টার, বেড়িবাঁধ, অভ্যন্তরীণ সড়ক, পানি সরবরাহ, স্কুল, খেলার মাঠ, পুকুর, মসজিদ, গার্ডেন, সোলার সিস্টেম, বনায়নসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের মাধ্যমে দ্বীপটিকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। উত্তাল সমুদ্রপথে চলাচলের সময় দূর থেকে মাথা উঁচু করা চারতলা ভবনগুলো চোখে পড়ছে। এ যেন ছোটখাটো এক আধুনিক শহর।
চলতি বছরের মে মাসে বিদেশে পাচারের সময় উদ্ধার হওয়া ৩০৬ রোহিঙ্গা এখন ভাসানচরে বসবাস করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে দুই শতাধিক নারী ও শিশু। এখন পর্যন্ত কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরু হয়নি।
শরণার্থী ও ত্রাণ প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার এ বিষয়ে বলেন, আমাদের পুরো আত্মবিশ্বাস আছে যে রোহিঙ্গারা স্বচক্ষে সুযোগ-সুবিধাগুলো যেহেতু দেখেছে, যাওয়ার বিষয়ে হয়তো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে।
ভাসানচর বাসযোগ্য কিনা, তা দেখতে চলতি মাসের শুরুতে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল চরটি পরিদর্শন করে। তারা সেখানে গড়ে তোলা অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেখে মুগ্ধ। রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের সদস্য মোস্তাফা কামাল জানান, তারা গাড়িতে ভাসানচরে ঘুরেছেন। সেখানে গড়ে তোলা স্থাপনা ও অবকাঠামোগুলো ভালো লেগেছে। এখানে নিরাপত্তার পাশাপাশি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির বাগান। আছে মহিষ পালন ও মাছ ধরার ব্যবস্থাও।
সরকারি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ভাসানচরে ২০১৫ সালে প্রথম শরণার্থীদের বসবাসের জন্য আবাসন গড়ার পরিকল্পনা করা হয়। সে সময় চরটিতে কোনো জনবসতি ছিল না। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার থেকে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে পালিয়ে এলে চরটিতে অবকাঠামো গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। টেকনাফ ও উখিয়ায় অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলোর জনাকীর্ণ অবস্থা এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ভাসানচর পরিকল্পনা (আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্প) দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। পলি জমে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ভাসানচরে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে নির্মাণকাজ শুরু হয়। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে মাত্র দেড় বছরে চরটিতে এক লাখ মানুষের বসবাসের উপযোগী অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়।
সূত্র জানায়, জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষায় ১৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সাগরের ঢেউ আটকানোর বিশেষ ব্যবস্থাসহ বালুর বস্তা এবং নুড়ি পাথর দিয়ে সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়া হয়েছে। এ ছাড়া চারতলা বিশিষ্ট ১২০টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মিত হয়েছে। এগুলো ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগের বাতাসেও অক্ষত থাকবে। এসব ভবনের কয়েকটিতে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কার্যালয় এবং কর্মীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা যাবে।
এসব ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ আধুনিক বাথরুমও রয়েছে। এখানে তৈরি করা হয়েছে এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রাম। মাটি থেকে চার ফুট উঁচুতে তৈরি হয়েছে এক হাজার ৪৪০টি টিনশেড পাকা ঘর। স্টিল এবং কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি একেকটি ভবনে ১৬টি বারো বাই চৌদ্দ ফুট ঘর রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটিতে এক পরিবারের চারজন করে থাকতে পারবেন। নারী ও পুরুষের জন্য রয়েছে আলাদা বাথরুম।
প্রতিটি ভবনে ৬৪ জনের জন্য থাকছে দুটি রান্নাঘর, যেখানে একসঙ্গে বেশ কয়েকটি চুলা ব্যবহার করা যাবে। চরটিতে বিদ্যুতের জোগান দিতে জেনারেটরের পাশাপাশি রয়েছে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় আয়োজন। টিউবওয়েল ছাড়াও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা ব্যবহারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে এই দ্বীপে। পাশাপাশি রয়েছে অনেক পুকুর, যেখানে মাছচাষ সম্ভব। ভাসানচরের অভ্যন্তরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে পুলিশ।
নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিতে চরটিতে ১২০টি সিসিটিভি ক্যামেরাও বসানো হচ্ছে। ভাসানচরে এরই মধ্যে একটি লাইট হাউসও স্থাপন করা হয়েছে, যেটির নাম দেয়া হয়েছে ‘আশার বাতিঘর’।
সূত্র আরো জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ভাসানচরের জন্য নেয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়। বাড়তি টাকা বাঁধের উচ্চতা বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা, আনুষঙ্গিক সুবিধা বাড়ানোসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হবে। হেলিপ্যাড, জ্বালানি ট্যাঙ্ক, সোলারসহ সব ধরনের সুবিধা থাকবে ভাসানচরে।
প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পটি সংশোধিত আকারে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২১ সালে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৯৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। পানি নিস্কাশন অবকাঠামো নির্মাণ, শোর প্রটেকশন ওয়ার্ক, জেটি নির্মাণ, জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের জন্য ভবন, কালভার্ট, ছোট আকারের লেক খনন, আরসিসি র্যাম্প নির্মাণ, জ্বালানি ট্যাঙ্ক, হেলিপ্যাড, চ্যানেল মার্কিং ও মুরিং বয়, বোট ল্যান্ডিং সাইট, মোবাইল টাওয়ার, রাডার স্টেশন, সিসি টিভি, সোলার প্যানেল, জেনারেটর, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন ইত্যাদি নির্মাণ করা হবে প্রকল্পের আওতায়।
শরণার্থী ও ত্রাণ প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ভাসানচরে খামার, হাতের কাজ শেখাসহ রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের জন্য আরো কিছু ব্যবস্থার কথা সরকার চিন্তাভাবনা করছে।
কক্সবাজারে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা জানান, রোহিঙ্গারা এমনতিইে ভাসান চরে যেতে প্রস্তুত। তবে কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ তাদেরকে বাধা দিয়ে আসছে। সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের বাধার কারণেই এতদিন সাধারণ রোহিঙ্গারা মুখ খুলছিল না।
এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সব পুলিশ সদস্যদের নির্দেশনা প্রদান করেছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন।
ডিআইজি জানান, রোহিঙ্গা শিবিরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য র্যাব-পুলিশ, আর্মড ব্যাটালিয়ান ও আনসার বাহিনীর যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে।
/এন এইচ