দেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
‘ভালো সময়’ কাটাতে গিয়ে জিম্মি হওয়ার গল্প
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ মানুষ এমন কিছু পাপ করে,যা কাউকে কোনোদিন বলতে পারে না। সেই পাপের কথা গোপণ রাখতে প্রয়োজনে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতেও মানুষ ইতস্তত করে না। আবার এই সমাজেই এমন কিছু লোক আছে, যারা মানুষের এই দুর্বলতার সুযোগটি লুফে নেয়। ঝোপ বুঝে কোপ মেরে লাখ টাকা হাতিয়ে পগার পার হয়। যিনি ভিকটিম হন, লোকলজ্জার ভয়ে সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা কাউকে কোনোদিন বলতেও পারেন না। পরিবার কিংবা স্বজন। শেয়ার করা তো দূরের কথা, উল্টো লুকিয়ে রাখতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন। পুলিশের এবারের অভিযানের ঘটনাটি এমনই একটি পাপকে ঘিরে।
এ ঘটনার ভিকটিমের বয়স ৪৫ বছর। পেশায় একজন ধান-চালের ব্যবসায়ী। মোটামুটি ভালোই আর্থিক অবস্থা তাঁর। ব্যবসার কাজে এখানে-সেখানে যান। কয়েকদিন আগে রংপুর থেকে নিলফামারী জেলার সৈয়দপুরে গিয়েছিলেন। বাসস্ট্যান্ডে নেমে একজনের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। কথায় কথায় অনেকভাব। যেন কাছের ‘স্বজন’। এক কথা। দুই কথা। কথার পিঠে কথা। অকথা-কুকথা। এক পর্যায়ে ওই ব্যক্তি ভিকটিমকে বললেন, আছে একজন। চাইলে কাটানো যাবে ‘ভালো সময়’। নিরিবিলি পরিবেশ। নেই কোনো সমস্যা কিংবা ঝুঁকি।
আদিম প্রবৃত্তির ‘টোপ’ ফেলতে পারলেন না তিনি। সাত-পাঁচ না ভেবেই তিনি রাজী হয়ে গেলেন। বাসস্ট্যান্ডে ক্ষণিক সময়ে পরিচিত সেই ‘স্বজন’কে অনুসরণ করা চলা শুরু করলেন। কোথায় যাচ্ছেন, কার সাথে যাচ্ছেন, কার কাছে যাচ্ছেন-সবই অচেনা। তবুও যাচ্ছেন। উদ্দেশ্য একটাই ‘ভালো সময়’ কাটানো।
‘স্বজনে’র সাথে গিয়ে অপরিচিত এলাকার ভবনের এক কক্ষে উঠলেন। এক নারীর সাথে ‘স্বজন’ তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বিদায় হলেন। বর্ণনার সাথে সবই মিলে গেল। নিরিবিলি পরিবেশ। বাসায় কেউ নেই। এবার ওই নারীর সাথে ‘ভালো সময়’ কাটানোর দরদামও সারলেন। তখনও তাঁর মনে হয়নি, সামনে কী ভয়ংকর বিপদ অপেক্ষা করছে!
শুরুর কয়েক মূহুর্ত বেশ ভালো সময় কাটল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ‘ভালো সময়’ কাটাতে এসে বেচারা এখন বেশ বেকায়দায়। সাথে থাকা নারী শুরুতে তাঁকে অভয় দিলেন। এমন একটা ভাব করলেন, যেন এ যাত্রায় তাঁকে অন্তত বাঁচিয়ে দেবেন। কিন্তু মুহুর্তেই সব পাল্টে গেল। ‘খুল্লাম খুল্লা’ অবস্থায়ই নারী গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। হইচই করে কয়েকজন কক্ষে ঢুকে পড়ল। ঢুকেই কেউ মারধর শুরু করল। কেউ ব্যস্ত ছবি তুলতে। কেউ আবার ভিডিও করতে। ভিকিটিমের বুঝতে বাকি থাকল না, এরা সবাই একই দলের লোক।
‘ভালো সময়’ কাটাতে এসে দোজখের অনুভূতি অনুভব করতে লাগলেন। এবার ভিকটিমের সাথে ওই নারীর আপত্তিকর অবস্থায় ছবি তোলা হল। ভিডিও করা হল। ধীরে ধীরে উপস্থিত মানুষগুলোর আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ পেতে লাগলো। ভিকটিম বুঝতে পারলেন, তিনি ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন। তিনি এখন কার্যত জিম্মি।
ব্ল্যাকমেইলের শুরুটা হলো ভয় দেখানোর মাধ্যমে। সাথে যা টাকা আছে দাও, নয়তো ছবি এখনই তোমার স্ত্রী-সন্তানের কাছে চলে যাবে। আরও ছড়াবে ইন্টারনেটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মান-সম্মানের ভয়ে সাথে থাকা সাড়ে আট হাজার টাকা দিয়ে দেন তিনি। ভাবলেন,এবার বুঝি মুক্তি। কিন্তু সে আশা যে গুড়ে বালি। টাকা পেয়ে এবার চক্রটির দাবি কয়েকগুণ বেড়ে গেল। চাই লাখ টাকা। ভিকটিম বললেন, সাথে আর টাকা নেই। যা ছিলো সবই দিয়েছি। চক্রটির সদস্যদের দাবি, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এনে দাও।
অন্য উপায় না থাকায় ভিকটিম পরিবার-স্বজন-বন্ধুদের কাছে ফোন করেন। সবকিছু লুকিয়ে শুধু জানান, জরুরী ভিত্তিতে ব্যবসার কাজে টাকার প্রয়োজন। এমন ফোনে হিতাকাঙ্ক্ষীরা টাকাও পাঠান। এরপর চক্রটির কয়েকজন সদস্য ভিকটিমকে নিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দোকানে যান। প্রথমে বিশ হাজার টাকা তুলে ছিনিয়ে নেন। এরপর টাকা তুলতে অন্য দোকানে যাওয়ার সময় কৌশলে ভিকটিম সেখান থেকে সটকে পড়ে দৌড়ে পালান।
এবার তিনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই কপালে দুশ্চিন্তা ভাঁজ। ছবি-ভিডিও তো ওদের কাছে রয়ে গেছে। যদি সত্যি সত্যি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়? পরিবারের সদস্যরা যদি জেনে যায়। কী হবে তখন?পুলিশকে জানাবেন? কিন্তু কি বলবেন পুলিশকে? নিজের এই লজ্জার কথা কি মানুষকে জানানো কি ঠিক হবে? এমন হাজারো প্রশ্ন যখন মাথায়, তখন সবকিছু ভুলে সৈয়দপুর থানায় গিয়ে হাজির হলেন। পুলিশকে খুলে বললেন ঘটনা।
ঘটনা শুনে ত্বরিত অভিযানে নামে পুলিশ। পুরো এলাকা ঘিরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ওই নারীসহ তিনজনকে তাৎক্ষণিকভাবে আটক করে। তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও কিছু টাকা উদ্ধার করা হয়। সেই মোবাইলেই মেলে ছবি ও ভিডিও।
এবার পুলিশের কাছে ঘটনা খুলে বলে আটক ব্যক্তিরা। তাদের ভাষ্যমতে, কয়েকজন সদস্য মিলে এ চক্রটি মানুষকে জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নেয়। তুলনামূলক আর্থিক অবস্থা ভালো এমন মানুষদের টার্গেট করে তারা। চক্রের এক বা দুই সদস্য বিভিন্ন কৌশলে টার্গেটকে নির্ধারিত বাসায় নিয়ে আসে। এরপর দলের নারী সদস্যের মাধ্যমে টার্গেটকে আপত্তিকর অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে চক্রের আরেকটি অংশের সদস্যরা ওই বাসায় হানা দেয়। ছবি তোলে ও ভিডিও করে। এরপর টার্গেটকে জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নেয়। এভাবে এই চক্রটি আরও কয়েকজনের থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রাথমিক স্বীকার করেছে।
এ ঘটনায় ভিকটিমের করা মামলায় এ পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের একজন ইতিমধ্যেই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বাকি আসামীদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যেকোনো ধরনের নৈতিক কিংবা চারিত্রিক বিচ্যুতি অনেক বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তেমনটা হতে যাচ্ছিল। কিন্তু ভিকটিম পুলিশের সহযোগিতা নেওয়ায় চক্রটি’র সদস্যদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।
এমন পরিস্থিতি এড়াতে ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক মূল্যবোধ মেনে চলুন। অনৈতিক পথে পা বাড়ানোর আগে পরিবারের কথা ভাবুন। নিজের মান-সম্মানের কথা চিন্তা করুন। তবুও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কেউ এমন পরিস্থিতির শিকার হলে গোপণ না করে পুলিশকে জানান। সঠিক তথ্য দিয়ে পুলিশের সহযোগিতা নিন। সর্বদাই জনগণের পাশে, বাংলাদেশ পুলিশ। টোপ দিয়ে জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের এক নারীসহ তিন সদস্যকে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে
/এন এইচ