করোনাপ্রধান শিরোনামস্বাস্থ্য
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কি ? এবং কেন ? কি বলছেন ভারতীয় চিকিৎসকরা
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ করোনা মহামারীর দুঃস্বপ্নের মধ্যে আরেক নতুন যন্ত্রণা উৎপাত আরম্ভ করেছে, তা হল ব্ল্যাক ফাঙ্গাস (mucormycosis)। ঘরে পড়ে থাকা পুরানো পাউরুটির ওপরে কিংবা ড্যাম্প ধরা দেওয়ালে কালো কালো ছাতা বা ফাঙ্গাস পড়তে আমরা সবাই দেখেছি। সেই জিনিস যে নাকের মধ্যে দিয়ে ঢুকে দেহে বাসা বাঁধতে পারে, সংক্রমণ ঘটিয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে, এমনকি খেয়ে ফেলতে পারে নাকের ভেতরে, চোখের ভেতরে, ফুসফুসের ভেতরের টিস্যু, এমনটা বাস্তবে ঘটা শুরু হয়েছে।
সারা বছরে সারা দেশে হয়ত হাতে গোনা গুটিকয়েক মানুষ এই ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয় কিনা সন্দেহ। আর আজ এক মহারাষ্ট্রতেই প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে এই রোগে। অথচ কেন এই রোগের বিস্তার হল সেটা অনুসন্ধান করলে খুব আপাত নিরীহ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যাবে হয়ত। যে স্টেরয়েড ওষুধের প্রয়োগের পর থেকে করোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে অদ্ভুত সুফল পাওয়া গেছে, যাকে বলা হয়েছে সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করলে game changer, আজ তাকেই এই ব্যধির জন্য দায়ী করে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। হ্যাঁ দীর্ঘ স্টেরয়েড ব্যবহারের ফলে রুগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এটা সত্যি, রক্তে শর্করার মাত্রা ভয়ানক বেড়ে যেতে পারে সেটাও সত্যি– কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে করোনা রুগীর ক্ষেত্রে স্টেরয়েড ব্যবহার হয় বড় জোর দুই থেকে তিন সপ্তাহ।
অথচ এমন কিছু অসুখ আছে যে ক্ষেত্রে রুগীদের দীর্ঘকাল কিংবা বলা ভাল সারা জীবনই স্টেরয়েড খেয়ে যেতে হয় কেননা সেটাই একমাত্র চিকিৎসা। Rheumatoid arthritis, SLE, Nephrotic syndrome এই ধরনের কিছু অসুখ। সেই সব রুগীদের মধ্যে mucormycosis এর প্রভাবের কথা তো কেউ বলছেনা বা ঘটছেনা। Uncontrolled blood sugar এর থেকে বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে আসা অনেক রুগী তো দেখেছি– কই এ ভয়ঙ্কর জিনিস ত একবারও চোখে পড়ল না আজ অব্দি। অনেক টার্মিনাল ক্যান্সার রুগী আমাদের হাসপাতালে ভর্তি থাকে, তাদের কারু নাক দিয়ে কালচে পুঁজ কিংবা রক্ত বেরিয়ে আসছে কিংবা চোখের চারপাশ কালচে রঙ ধরে ফুলে উঠছে–তেমন কখনো ঘটেনি। তাহলে ব্যাপারটা কি একটু অনুসন্ধান করতে হয়।
ভারতীয় পদ্ম ভূষণ সম্মানিত ডঃ রামাকান্ত পান্ডা (Managing Director, Asian Heart Institute, Mumbai) দুটি প্রশ্ন তুলেছেন।
১) ভারতে প্রতি বছর লক্ষাধিক ক্যান্সার, ডায়াবিটিস এবং স্টেরয়েড নেওয়া রুগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। কারোর তো কোনদিনও এই অসুখ হয়নি।
২) সারা বিশ্বে যে লক্ষাধিক কোভিড রুগীর চিকিৎসা হয়েছে তাদের অধিকাংশই ডায়াবেটিক। তাহলে কেন সেই সব দেশেও ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের উৎপাত পরিলক্ষিত হয়নি?
এই দুই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই বোঝা যাবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কি এবং কেন।
উত্তর একটাই— অপরিচ্ছন্নতা, অপরিচ্ছন্নতা এবং অপরিচ্ছন্নতা।
বেশির ভাগ হাসপাতালে অক্সিজেন দেবার যে আয়োজন সেটা কেউ কোনদিন ভাল করে লক্ষ্য করেছেন?
চোখে পড়েছে কি অক্সিজেনের যে মাস্কটা রুগীর মুখে লাগানো হয় সেটা অব্যবহৃত অবস্থায় কোথায় থাকে? পড়ে থাকে যত্র তত্র। নলের ক্ষেত্রেও একই কথা। কারো নাকের ভেতরে যেটা যাচ্ছে, লালা লাগছে, সেটা মুছে পরিষ্কার করে রাখার ব্যবস্থা আছে কি? এইসব জৈব দেহরস যে ছত্রাকের বৃদ্ধির জন্য চমৎকার মিডিয়াম সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তারপর যে বোতলে কিছুটা পানি থাকে সিলিন্ডারের সঙ্গে লাগানো, যার ভেতর দিয়ে অক্সিজেন যায়, সেই পানি ঘনঘন বদল করার নিয়ম। বোতলে ঢালা উচিত distilled water. এখন বেশির ভাগ জায়গাতেই distilled water ব্যবহার না করে কলের পানি ভরে দেওয়া হয়। এইভাবেও ছত্রাকের বিজ (spore) এসে যেতে পারে। তারপরেও এই পানিটা পাল্টানো হয়না দিনের পর দিন। খুব বেশি হলে পানি কমে এলে ওপর থেকে আবার ঢেলে দেওয়া হয়; বোতলের মুখ খুলে পরিষ্কার করে পানি বদলানো হয়না।
স্যালাইনের পাইপ কিংবা অক্সিজেনের নল মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে তা দেখেই আমরা অভ্যস্ত। তাই আজ এইভাবেই মাশুল গুনতে হচ্ছে।
এখন কেউ বলতেই পারে এই সব অস্বাস্থ্যকর ব্যাপার ত সব সময়েই হয়, তাহলে এই mucormycosis হঠাৎ আবির্ভাব হল কেন? সময়টা খেয়াল করুন। দ্বিতীয় ঢেউ আরম্ভ হল মার্চের শেষ থেকে। এপ্রিলে চরম হল অবস্থা। যে স্বাস্থ্যসেবা তার সমস্ত দোষগুণ সত্ত্বেও ধুঁকে খুঁড়িয়ে চলে, এই হাজার হাজার রুগীর চাপে সে একেবারে মাজা ভেঙে বসে পড়ল। যেটুকু নিয়ম মাফিক পরিচ্ছন্নতা পালন করা হত, হাসপাতালগুলি আর পেরে উঠল না। সরকার, বেসরকার–বেড পেতে দিল এদিক সেদিক—কিন্তু প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নার্স কিংবা ওয়ার্ড বয় তো আর হাততালি দিলেই মেলে না। ফলে বিছানা রইল কিন্তু ন্যুনতম হাইজিন রইল না। মানুষ এখান সেখান থেকে ধার করে, জোগাড় করে অক্সিজেন বাড়িতে ব্যবহার করতে লাগল। সেগুলির অবস্থা আরও শোচনীয়।
তার সঙ্গে এই গ্রীষ্ম প্রধান দেশের আর্দ্রতা আর গরম মিলিয়ে ছত্রাকদের পোয়া বারো করে দিয়েছে। যে ছত্রাককে নিয়েই আমাদের ঘর করা–আগানে বাগানে গোবরের গাদাতে যে চিরকাল বেচে বর্তে থেকেছে–আমাদের বদ অভ্যাস, পরিচ্ছন্নতাহীনতা, স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদাসীনতা তাকেই সাদরে ডেকে এনে শরীরে বাসা বাঁধতে দিয়েছে।
মনে রাখা দরকার এই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ কিন্তু কোভিডের থেকে বেশি বিপদজনক। ৫০% এর বেশি সংক্রমিতের মৃত্যু ঘটায় এই রোগ। নাহলে কিছু না কিছু অঙ্গ হানী হবে, তার মধ্যে চক্ষু প্রধান। তাই ছোট ছোট জিনিসের দিকে নজর দেবার সময় এসেছে। রেমডেসিভির ইঞ্জেকশন দেবার কথা আগে না ভেবে রুগীর অক্সিজেনের মাস্কটা নলটা স্পিরিট দিয়ে পরিষ্কার করার কথা ভাবাটা জরুরি।
কোভিডের প্রথম ঢেউ আমাদের একটা জরুরি শিক্ষা দিয়েছে। ভাল করে সাবান দিয়ে কেমন করে হাত ধুতে হয়। দ্বিতীয় ঢেউ নাহয় এইটাই শিখিয়ে যাক। অক্সিজেন ডেলিভারি , ব্যবহার হাইজিন মেনে খুব সতর্ক ভাবে করা হোক।
নাহলে সমূহ বিপদ।
লেখকঃ ডা. ধরিত্রী গোস্বামী
খরগপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
/আরএম