আমদানি-রপ্তানীপ্রধান শিরোনামশিল্প-বানিজ্য
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দরপতন, সুযোগ নিতে চায় বাংলাদেশ
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ করোনাভাইরাস সারা দুনিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বহু কিছু পাল্টে দিয়েছে। কিন্তু কতটা পাল্টে দিয়েছে, সেটি কি আন্দাজ করতে পারবেন? বাস্তবতা আপনার কল্পনাকেও হার মানাবে। অনেকে পণ্যের দাম কম হলে তা ‘পানি’র দামের সঙ্গে তুলনা করা হয়, যদিও বহু দেশে সুপেয় পানির দাম অনেক বেশি। অনেকে তুলনা করেন শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় আট মণ চালের সঙ্গে। তবে এসব এখন নস্যি তেলের দামের কাছে। এক ব্যারেল অপরিশোধিত তেল কিনলে দাম তো লাগবেই না, উল্টো আপনাকে দেওয়া হবে ৩৭.৬৩ ডলার।
কথাটি অবিশ্বাস্য মনে হলেও গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেলের ব্র্যান্ড ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) বাজারের সূচক ছিল এমনই। দুনিয়ায় এই প্রথম তেলের দাম শূন্যের নিচে চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে এর পরপরই তেলের বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বছরজুড়ে তেলের বাজার ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারে ঘোরাফেরা করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কতটা সুবিধা নিতে পারবে, সেটাই মূল বিবেচনা। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ কম দামের সুফল পাওয়া শুরু করেছে। গত বুধবার পর্যন্ত প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ২০ থেকে ২১ ডলারের মধ্যে বিক্রি হয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর তথ্যমতে, সারা দুনিয়ায় তেল মজুতের যত সুযোগ আছে, তাতে সর্বোচ্চ ৬৮০ কোটি ব্যারেল তেল রাখা সম্ভব। ইতিমধ্যে এ মজুতের ৬০ ভাগ জায়গাই ভরে গেছে। বাকি যেসব জায়গা আছে, তা আগামী দুই মাসের আগাম কেনা তেলে ভরে যাবে।
দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেলের ব্যবহার হয় যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে তেল মজুতের ৭৫ শতাংশই ভর্তি। যদি বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সব তেল রাখার সংরক্ষণাগার আগামী মে মাসে ভর্তি হয়ে যাবে।
দক্ষিণ আমেরিকার সব থেকে বড় তেলের বাজার হলো ব্রাজিল। ব্রাজিলে তেল রাখার কোনো জায়গা নেই। ক্যারিবীয় দেশগুলোতেও তেল রাখার জায়গা নেই। একই অবস্থা আফ্রিকার আরেক বড় অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায়। এ ছাড়া নাইজেরিয়া ও অ্যাঙ্গোলাতেও জায়গা নেই।
তেলের দাম পড়ছেই
চলতি এপ্রিল মাস থেকেই দৈনিক ২ কোটি ৯০ লাখ ব্যারেল তেলের ব্যবহার কমেছে। করোনাভাইরাসের কারণে দুনিয়া থমকে গেছে। এতে সারা দুনিয়ার কলকারখানা, যানবাহন, বিমান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তেলের ব্যবহার বিপুলভাবে কমে গেছে। গত বছর প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম গড়ে ৬৪ ডলার ছিল। আর চলতি এপ্রিলে তা ফ্রি-তে পরিণত হয়েছে। অবশ্য দাম সেখান থেকে বেড়েছে।
তেলের দাম বাড়ানোর নানা চেষ্টা বিশ্বব্যাপী করা হচ্ছে। এর মধ্যে ওপেকভুক্ত দেশগুলো সম্মিলিতভাবে দৈনিক ১০ কোটি ব্যারেল (১০০ মিলিয়ন ব্যারেল) তেল উত্তোলন বন্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজের তেল উত্তোলন কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। তারপরও তেলের দরপতন ঠেকানো যাচ্ছে না। পৃথিবীতে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে, যে তেলের ব্যবহার নেই, বাজারও নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের তেলের মজুত নির্ধারণকারী সংস্থা টেক্সাস রেইলরোড কমিশন সম্প্রতি সে দেশের ২০ শতাংশ তেল উৎপাদন কমানোর নির্দেশ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমসকে ন্যাচারাল রিসোর্সেসের প্রধান নির্বাহী স্কট শেফিল্ড বলেন, যদি তেলের ব্যারেল ২০ ডলার থাকে তাহলে অন্তত ৮০ শতাংশ তেল কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাবে। আড়াই লাখ লোক চাকরি হারাবেন। আর যদি ৩০ ডলারে থাকে, তাহলে অনেক কোম্পানি সংকটে পড়বে ঠিকই কিন্তু এ খাতটি বেঁচে যাবে।
২০১০ সালে গড়ে সারা বছর প্রায় ১০০ ডলারে বিক্রি হয়েছে ব্রেন্ট ব্যারেল। মূলত ২০১৪ সাল থেকে তেলের দাম পড়তে থাকে। তবে তা কখনোই আজকের পরিস্থিতিতে এসে নামেনি। প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ২০১৫ সালে ৩৭.০৪ ডলার, ২০১৬ সালে ৫৩.৭২, ২০১৭ সালে ৬০.৪২, ২০১৮ সালে ৪৫.৪১ ও ২০১৯ সালে ছিল ৬১.০৬ ডলার।
বর্তমান পরিস্থিতি কেউ এর আগে দেখেননি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা দুনিয়ার ভঙ্গুর অর্থনীতির সময়ও পরিস্থিতি এমন ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল সাড়ে ১৬ ডলার। তেলের বাজারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সীমিত পরিসরের বিভিন্ন দেশে দেশে যুদ্ধ, বিশ্ব মন্দা ও ভূরাজনীতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু একটি ভাইরাসের সঙ্গে তেলের বাজারের সম্পর্ক থাকতে পারে, তা বিশেষজ্ঞদের ধারণাও ছিল না।
তেল মজুত রাখতে বিপিসির অভিনব পরিকল্পনা
বছরে গড়ে প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টন তেল কিনে থাকে বিপিসি। এর মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ টন বিপিসির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) বা দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় তেল শোধনাগার থেকে আসে। ক্রুড বা অপরিশোধিত তেল আমদানি করে ইআরএল পরিশোধন করে ডিজেল ও অন্যান্য তেল সরবরাহ করে। চাহিদার বাকিটা পরিশোধিত তেল আমদানি করে বিপিসি। সারা দেশে বিপিসির ৬০ দিনের জ্বালানি তেল মজুত রাখার সক্ষমতা আছে। মজুত বাড়ানোর জন্য পার্বতীপুরে ২১ হাজার টনের ট্যাংকার তৈরি করা হচ্ছে। জাহাজ থেকে সরাসরি পাইপলাইনে তেল নেওয়ার একটি প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে কক্সবাজারে। এটি শেষ হলে ৯০ হাজার টন তেল মজুত রাখা যাবে। এ ছাড়া ইআরএল ইউনিট-২ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেটি সম্পন্ন হলে ইআরএল প্রথম ইউনিটের সঙ্গে আরও ৩০ লাখ অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করা যাবে, তাতে বাড়বে মজুতের পরিমাণ।
এসব তো নির্মাণাধীন প্রকল্প। কিন্তু এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ার ফলে কতটা সুযোগ নিতে পারবে বাংলাদেশ—এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল বিপিসির চেয়ারম্যান সামছুর রহমানের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে মজুতের সমস্যা সমাধানে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। এর মধ্যে প্রথম উদ্যোগ হলো বেসরকারি যেসব ট্যাংকার আছে, তা ভাড়া নেওয়া। ইতিমধ্যে আমরা ইউনাইটেড গ্রুপের একটা ট্যাংকারে তেল রাখার ব্যাপারে রাজি করিয়েছি, সেখানে রাখব ৭০ হাজার টন ডিজেল। এভাবে বেসরকারি আরও অনেক উদ্যোক্তা রয়েছে, যাদের ট্যাংকার ভাড়া নেওয়া গেলে তেলের মজুত শিগগির বাড়ানো যাবে। তা ছাড়া যেসব তেলের লাইটার জাহাজ আছে, এ রকম জাহাজ ভাড়া করার জন্য আমরা কথা বলছি। তাতে জাহাজগুলো তেল নিয়ে আমাদের জন্য সাগরেই ভেসে থাকবে।’
সামছুর রহমান বলেন, বিপিসি এখন লাভ করছে। যদি তেলের দাম সরকার না কমায়, তাহলে বিপিসির এই লাভ অনেক হবে। বিপিসি স্বাধীনতার পর বেশি দামে তেল কিনে কম দামে বিক্রি করে এসেছে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাছে সরকারের অর্থ বিভাগ হাজার হাজার কোটি টাকা পাবে। তবে সম্প্রতি কিছু বছর তেলের দাম কমায় বিপিসি লাভের মুখ দেখছে। তেলের মজুত বাড়ানো গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তার সুযোগ নেওয়া যায়। এটি জ্বালানি নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।