দেশজুড়ে
পীরগঞ্জে ত্রাণের চাল ও টাকার হিসেবে গড়মিল নিয়ে তোলপাড়
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ রংপুর জেলার পীরগঞ্জে ত্রাণের চাল ও টাকা বিতরণে নানা অনিয়মের খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশের প্রেক্ষিতে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হবার পর নড়েছে কর্তৃপক্ষের টনক।
গত ২৩ এপ্রিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) টিএমএ মমিন প্রকাশিত ওই সংবাদের জবাব দিতে গিয়ে হাতেগোনা কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিকের কাছে যে হিসেব প্রদান করেছেন তার সাথে কোন মিল নেই উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শফিউর রহমান মন্ডল মিলন কর্তৃক প্রদানকৃত হিসেবের। এর আগে ‘পীরগঞ্জে ত্রাণ নিয়ে তেলেসমাতি’ শিরোনামে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
পাঁচটি বরাদ্দপত্রে প্রাপ্ত ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা ও উপজেলা পরিষদের বরাদ্দকৃত দুই লাখসহ মোট ১১ লাখ ২০ হাজার টাকার হিসেব দিয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি তার ফেসবুক একাউন্টে উল্লেখ করেছেন আলু ও মিষ্টি কুমড়া ক্রয় ৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকা, ডাল ক্রয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, বস্তা ক্রয় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা, বস্তায় ছাপানো ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। হাতে রয়েছে ৬ হাজার টাকা। অথচ ইউএনও টিএমএ মমিন এর দেওয়া হিসেবের সাথে ঐ হিসেবের গড়মিল দেখা যায়। ইউএনও উল্লেখ করেছেন প্রাপ্ত বরাদ্দ নগদ ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ডাল ক্রয় ১৫৭৫ কেজি ৮০ টাকা দরে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা, আলু ৪৭২৮ কেজি ১৯ টাকা দরে ৮২ হাজার ৮৪৬ টাকা, পুরাতন বস্তা ও সুতলী ক্রয় ৭ হাজার ৯০০ টাকা, ভ্যান ভাড়া ও লেবার ৪৮ হাজার ৬২০ টাকা, মাস্ক ও স্যানিটাইজার ক্রয় ৬ হাজার ৪১৫ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৭ হাজার ৫২০ টাকা হারে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, শিশু খাদ্য ও গুড়া দুধ ক্রয়-১৭০০ প্যাকেট ১৬৫ টাকা হারে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ২০ হাজার বস্তা ক্রয় ৯ টাকা দরে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা, বস্তায় ছাপানো প্রতিটিতে ৮ টাকা দরে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। নগদ হাতে রয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৮১ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তদন্ত কমিটিকে ম্যানেজ করতেই তড়িঘড়ি করে হিসেব মেলাতে গিয়ে এ বিপত্তি ঘটে গেছে। ত্রাণ বিতরণের সরকারি নির্দেশ অমান্য করে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মন্ডল, ভাইস চেয়ারম্যান শফিউর রহমান মন্ডল মিলন ও ইউএনও টিএমএ মমিন মনগড়া তালিকা তৈরি করে ত্রাণ বিতরণের নামে নিজেদের জাহির করেছেন। প্রতিটি পণ্য ক্রয় ও অন্যান্য খাতে বিপুল পরিমান অর্থ সাশ্রয় পূর্বক পকেটস্থ করা হয়েছে। সরেজমিন তদন্ত করলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে বলে দাবি করেছে এলাকার একাধিক সুত্র।
এদিকে সাংবাদিকরা ত্রাণ বিতরণের পরিস্থিতি জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মিজানুর রহমান জানান, ৯ ধাপে উপজেলায় ত্রাণ হিসেবে ২৫১ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে জেলা প্রশাসক। প্রতিটি ইউনিয়নে প্রথম পর্যায়ে ১২৫ জন, ২য় পর্যায়ে ২০০ জন, ৩য় পর্যায়ে ৩০০ জনসহ ৪র্থ ধাপে ৬০০ জনের (প্রক্রিয়াধীন) প্রত্যেককে ১০ কেজি করে ইউনিয়ন প্রতি সোয়া ১২ মেট্রিকটন হিসেবে ১৫টি ইউনিয়নে ১৮৩.৭৫ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়াও পৌরসভায় প্রথম পর্যায়ে ১২৫ জন, দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩০০ জন, তৃতীয় পর্যায়ে ৫০০ জন ও চতুর্থ পর্যায়ে ৭০০ জনের (প্রক্রিয়াধীন) প্রত্যেককে ১০ কেজি করে সোয়া ১৬ মেট্রিকটন বরাদ্দ দেওয়া হয়। ইউনিয়ন ও পৌরসভা মিলে ২০০ মেট্রিকটন বরাদ্দের তথ্য দেন তিনি।
অবশিষ্ট চাল ও টাকার বিভাজন সম্পর্কে জানতে চাইলে পিআইও বলেন, ইউএনও টিএমএ মমিন, উপজেলা চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মন্ডল ও ভাইস চেয়ারম্যান শফিউর রহমান মন্ডল নিজেরাই বিতরণ করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঐ তিনজন ৫১ মেট্রিকটন চাল ও নগদ টাকা বিতরণ করলেও কাগজে কলমে বড় আলমপুর, পীরগঞ্জ সদর ও রামনাথপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নামে ডিও (ডেলিভেরি অর্ডার) দেখানো হয়। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের মধ্যে পীরগঞ্জ সদর ইউপি চেয়ারম্যান ডিও স্বাক্ষরে অপরাগতা প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ময়না বলেন, ডিওতে স্বাক্ষর চাইলেও আমি স্বাক্ষর করিনি। আমার ইউনিয়নের নামে বরাদ্দ ইউএনও সাহেব কেন বিতরণ করবেন!
বড়আলমপুর ইউপি চেয়ারম্যান হাফিজার রহমান বলেন, আমার নামে বরাদ্দকৃত চাল ইউএনও স্যার নিয়েছে। তিনি কোথায় দিয়েছেন, তা আমি জানি না। একই ধরণের মন্তব্য করেন রামনাথপুর ইউপি চেয়্যারম্যান ছাদেকুল ইসলাম বিএসসি। রায়পুর ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান দুলাল চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি ত্রাণ এখানে হরিলুট করা হচ্ছে। আর আমরা দরিদ্র মানুষের অত্যাচারে বাড়িতে থাকতে পারছি না।
এ প্রসঙ্গে ইউএনও টিএমএ মমিন জানান, আপদকালীন হিসেবে বিধিসম্মতভাবে ওই চাল উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, পীরগঞ্জে ত্রাণের (জিআর) ৫১ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা সঠিক হিসাব না থাকার বিষয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর প্রকাশ হলে ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসক স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক (ডিডিএলজি) সৈয়দ ফরহাদ হোসেন ও জেলা ত্রাণ পুর্ণবাসন কর্মকর্তা এটিএম আকতারুজ্জামানসহ দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
/আরএম