বিশেষ প্রতিবেদনশিক্ষা-সাহিত্য
পশ্চিম ভারতে প্রবাসী বাঙালি জীবন- এক আশ্চর্য মেলবন্ধন ‘নৌকাডুবি’
আব্দুল্লাহ আল কাউসার: “আমরা যাহা পাইয়াছি তাহা কখনোই হারাইতে পারি না, যাহা যথার্থ পাই নাই তাহাই হারাই” (নৌকাডুবি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
‘দান চোখে দেখা যায়, কিন্তু আদান হৃদয়ের ভিতরে লুকানো’-নৌকাডুবি
চরিত্রসমূহ, চরিত্রপ্রধান এই উপন্যাসে রমেশ, হেমনলিনী, কমলা ও নলিনাক্ষ- চারজনকেই ঔপন্যাসিক যত্ন করে নির্মাণ করেছেন।‘পশ্চিমের চক্রবর্তী খুড়ো’ এই উপন্যাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এছাড়াও আছে হেমের গুণমুগ্ধ অক্ষয়, মেয়ের প্রতি অনুভূতিশীল অন্নদাবাবু, কমলার স্নেহধন্য উমেশ, মমতার প্রতিমূর্তি ক্ষেমংকরী, যোগেন্দ্র ও শৈলজা। নিম্নে উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে বর্ণনা করা হল।
রমেশ
নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করে যে সমস্যার সূত্রপাত সে করেছিল, সেখান থেকেই এগিয়েছে নৌকাডুবির কাহিনীচিত্র। রমেশের চরিত্রে দ্বিধার অংশই প্রধান। কমলার জীবনের সত্যিটা জানার পরও কমলাকে সব কিছু বুঝিয়ে বলার মতো দৃঢ়তা তার ছিল না।ঘটনাপ্রবাহ তাকে যেভাবে টেনে নিয়ে গেছে, যেদিকে নিয়ে গেছে রমেশও সেই দিকেই গেছে। শেষ পর্যন্ত যখন কমলাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে চাইল, ততক্ষণে কমলা হারিয়ে গেছে নদীর স্রোতধারায়।
কমলা
কমলার মতো ভাগ্য বিড়ম্বিত চরিত্র এই উপন্যাসে তো নয়ই, রবি ঠাকুরের অন্যান্য উপন্যাসেও বিরল। পদ্মার উন্মুক্ত জনহীন দ্বীপে রমেশকে স্বামী হিসেবে ভেবে নিতে এক মুহূর্তও দেরি হয়নি তার। রমেশকে নিয়েই তার নিস্তরঙ্গ নিরুপদ্রব জীবন কেটে যেতে পারত। ভজকট করে দিল একটা চিঠি। তাও পুরোটা নয়। শুধু একটা নাম- ‘নলিনাক্ষ চট্টোপাধ্যায়’- এটুকু সম্বল করে সে রমেশের দেয়া মিথ্যে সংসার ফেলে বেরিয়ে পড়েছিল। তার সে নিরুদ্দেশ যাত্রা ব্যর্থ হয়নি।
নলিনাক্ষ
নলিনাক্ষের চরিত্রের ব্যাপ্তি ছোট রমেশের সাথে তুলনা করলে, উপন্যাসের মাঝামাঝি এসে অক্ষয়ের মাধ্যমে আমরা নলিনাক্ষের সাথে পরিচিত হই। কাশী প্রবাসী বাঙালি এই ডাক্তারবাবু একদিকে যেমন বড় বড় সভায় আধ্যাত্মিক বক্তৃতা দিতে পারেন, তেমনি চায়ের টেবিলে উপস্থিতিতেও তাকে পাওয়া যায়। নিজের পেশার প্রতি নিষ্ঠা, মায়ের প্রতি আশ্চর্য শ্রদ্ধাবোধ,অদেখা অচেনা স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা।
হেম-নলিনী
বিংশ শতাব্দীর কলকাতা শহর আর সেই শহরের একটি শিক্ষিত রুচিশীল অবস্থাপন্ন ব্রাহ্মণ পরিবার এবং সেই পরিবারের সবার আদরের একমাত্র মেয়ে এই হল হেমনলিনী। হেমনলিনীর যেমন পরীক্ষায় পাস করতেও তার জুড়ি নেই, তেমনি আপনজনের জন্য রেশমের সেলাই শিখতেও তার আপত্তি নেই। গান বাজনায়, কবিতায়, সভা সমিতিতে আর বক্তৃতা শোনায় সবখানে তার পদচারণ। আবার নলিনাক্ষের মায়ের সেবার ভারও সে গ্রহণ করেছিল। শুধু রমেশের প্রণয়িনী কিংবা অন্নদাবাবুর আদরের হেম নয়, নিজের যোগ্যতায় সে এই উপন্যাসের এক আশ্চর্য সংবেদনশীল চরিত্র।
নৌকাডুবি রোমান্টিক ধাঁচের উপন্যাস। চিরায়ত সামাজিক উপন্যাসও বলা হয়ে থাকে। সামাজিক অসঙ্গতি, কুসংস্কার, দৃষ্টিভঙ্গি এর পরিবর্তে গল্পের উপজীব্য ছিল ভাগ্যচক্র আর নিয়তির খেলা। মনের কুটিলতা, ষড়যন্ত্র, হিংসা-দ্বেষ এর জায়গায় ফুটে উঠেছে মানব-মানবী মনের আদিম এবং সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো।
ঘটনার শুরুতেই আকস্মিক ভাবে কলকাতায় এসে উপস্থিত হন রমেশের বাবা ব্রজমোহন । ব্রজমোহনের প্রবল ব্যক্তিত্বের কাছে রমেশ পরাজিত হয় বাবার বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করতে প্রথমে দোনোমনা করলে । ফেরার পথে ‘একটা ঘূর্ণা হাওয়া একটি সংকীর্ণ পথমাত্র আশ্রয় করিয়া প্রবলবেগে সমস্ত উন্মীলিত বিপর্যস্ত করিয়া দিয়া নৌকা কয়টাকে কোথায় কী করিল তাহার কোনো উদ্দেশ্য পাওয়া গেল না’। নৌকাডুবি উপন্যাসের নাম দেয়া হয়েছে মূলত এই ঘটনার জন্যই।
রমেশ আর যোগেন্দ্র দুই সহাধ্যায়ী। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার কারণে প্রায়ই যোগেন্দ্রদের বাড়িতে আসাযাওয়া ছিল রমেশের। যোগেন্দ্রর ছোট বোন হেমামালিনী। হেমামালিনী আর রমেশ দুইজনেই পরস্পরের প্রতি দুর্বল ছিল। আইন পাশ করার সাথে সাথেই রমেশের বিয়ে দিয়ে দেয় তার বাবা। রমেশের জোর আপত্তি কোনো ধোপে টিকেনি। বিয়ে হয় গ্রামের বাড়িতে। বিয়ের পর বউকে নিয়ে বাড়িতে আসার পথে ঘটে বিপত্তি। প্রচণ্ড ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বরযাত্রীদের নৌকার বহর। রক্ষা পায় শুধু রমেশ। সাথে রক্ষা পায় কমলা রমেশের স্ত্রী। ভাগ্যকে মেনে নিয়ে নতুন স্ত্রীর সাথে সংসার শুরু করতে গিয়ে রমেশ আবিষ্কার করে এই মেয়ে তার নিজের বউ না! ঝড়ের সময় তাদের পাশাপাশি আরো একটি নৌকাডুবি হয়— যার হতভাগী শিকার কমলা। নীতির গ্যাঁড়াকলে ফেঁসে গিয়ে রমেশ না পারছিলো এই মেয়েকে ত্যাগ করতে, না পারছিলো ঠিকমত গ্রহণ করতে। ওইদিকে হেমামালিনীর প্রতি তার দুর্বলতা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
হেমামালিনীর বাসায় রমেশের বিয়ের কথা কেউ জানতো না। বিয়ের পরও রমেশের সেই বাড়িতে যাতায়াত অব্যাহত ছিলো। এই সময়টুকুতে রমেশ আর হেমামালিনীর দুর্বলতা পরিণত হতে থাকে গভীর প্রণয়ে। আকস্মিকভাবে রমেশের বিয়ের খবর জেনে যায় যোগেন্দ্র। রমেশের সাথে তার পরিবার থেকে সব ধরনের সম্পর্ক ছেদ করা হয়, বন্ধ করে দেয় যোগাযোগ। কমলাকে নিয়ে রমেশ দূরের পথে পাড়ি জমায়। নতুন করে জীবন শুরু করাই তার লক্ষ্য। কিন্তু নিয়তি যাদের এক সুতোয় গাঁথা তাদের কি আলাদা করা যায় দূরত্বের দেয়াল দিয়ে?
রোমান্টিক ধাঁচের উপন্যাসগুলো কিছুটা ধীরস্থিরভাবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। এখানেও কিছুটা স্লো মোশনে এগিয়েছে সব কিছু। বইয়ের এক-দশমাংশ পড়ার পরও বুঝতে পারছিলাম না সমস্যা কোথায়— এই বই এত বড় হল কিভাবে! কাহিনী কোন দিকে গড়াবে আগে থেকে বোঝা যাচ্ছিলো না। যখনই মনে হয়েছে এই বুঝি শেষ হল, তখনই গল্পে এসেছে নতুন নতুন মোড়। শেষটা দেখার জন্য উদগ্রীবতা ক্রমশ বাড়ছিলো। কিভাবে শেষ হবে বিন্দুমাত্র ধারণা করতে পারছিলাম না।
“আমরা যাহা পাইয়াছি তাহা কখনোই হারাইতে পারি না, যাহা যথার্থ পাই নাই তাহাই হারাই”
হয়তো এই একটি লাইনেই কবিগুরু পুরো উপন্যাসটিকে তুলে এনেছে। গ্রামবাংলার চিরায়ত প্রকৃতি, বিংশ শতাব্দীর ক্রমবর্ধমান কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, আবার এর সাথে পশ্চিম ভারতে প্রবাসী বাঙালি জীবন- সবকিছুর এক আশ্চর্য মেলবন্ধন ‘নৌকাডুবি’।
/আরএম