প্রধান শিরোনামবিশেষ প্রতিবেদন

নিজের মতো করে বাঁচতে শিখেছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ নিজের মতো করে বাঁচতে শিখেছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। মানুষের পদচিহ্ন নেই। উন্মুক্ত সৈকতে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ক্ষুদে লাল কাঁকড়ার দল; যেন লাল কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে কেউ। ডিম পাড়তে আসছে নানা প্রজাতির কচ্ছপ। কেঁচোর আলপনা দেখা যাচ্ছে প্রতি কদমে কদমে, বাসা বেঁধেছে গাঙ কবুতরের দল। আর ডলফিনের উচ্ছল নৃত্যে আন্দোলিত সাগরের কথা তো সবারই জানা। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এতটা বদলে গেল তাও আবার মাত্র ৫০ দিনে। বিষয়টা অবাক করার মতোই। অথচ দুই মাস আগেও লাখো পর্যটকের সমাগমে সৈকত ছিল ক্লান্ত। এখন পাল্টে গেছে সেই দৃশ্য। গত ১৮ মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রভাবে পর্যটকদের আসা যাওয়া বন্ধ রয়েছে কক্সবাজারে। এ বিরল নির্জনতার সুযোগ নিয়েছে সাগরপাড়।

সাগরলতার নবযৌবনা

মানুষের পদচারণা বন্ধ হওয়ার সুযোগে প্রায় দুই দশক পর কক্সবাজার সৈকতের বিশাল এলাকাজুড়ে ফিরে এসেছে ‘সাগরলতা’। যার ইংরেজি নাম ‘মর্নিং বিচ গ্লোরি’। প্রথমে কক্সবাজারের দরিয়ানগরে নবযৌবন পায় সাগরলতা। এরপর আরো বেশ কয়েকটি এলাকায়ও গাঢ় সবুজ ডানা মেলেছে সাগরলতা।

সাগরলতার ফুলগুলোও বেশ সুন্দর

সমুদ্র সৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে রাখে বড় বড় বালির পাহাড় বা বালিয়াড়ি। সাগরে ঝড়-তুফান বা ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস উপকূলে ঠেকিয়ে রাখে বলে বালিয়াড়িকে সৈকতের রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বালিয়াড়ি তৈরির মূল কারিগর হিসেবে পরিচিত সাগরলতা।

এক দশক আগেও কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতজুড়ে গোলাপি-অতিবেগুণি রঙের ফুলে ভরা এক অন্যরকমের সৌন্দর্যময় পরিবেশ ছিল। দখল ও দূষণের শিকার হয়ে প্রায় তিন দশকে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতের বড় বড় বালিয়াড়িগুলো প্রায় হারিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সমুদ্র তীরভাঙনের শিকার হয়ে হাজার হাজার একর ভূমি সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

কক্সবাজারের সেই সময়কার পরিবেশের কথা ভেবে শহরের অনেক বাসিন্দা ও পর্যটক এখন কেবলই আক্ষেপ করেন। কিন্তু সেই সুযোগটিই ফের এনে দিয়েছে করোনা সতর্কতা। কক্সবাজারের বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, আবার আগের মতো ‘ডেইল’ (বালিয়াড়ির কক্সবাজারের আঞ্চলিক নাম) দেখা যাচ্ছে। অনেক জায়গায় সাগরলতাও উঠেছে।

সাগরলতা ফুলগুলোও বেশ সুন্দর। বড় ও ফানেল আকৃতির, রং বেগুনি থেকে বেগুনি-গোলাপি। পাতাগুলো রসাল এবং বৃত্তাকার খাঁজকাটা টিপের মতো দেখতে। স্থানীয়ভাবে এর ওষুধি ব্যবহারও রয়েছে। জেলিফিশ এর আঘাতে সৃষ্ট বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে জেলে সমাজ এই পাতার রস ব্যবহার করে থাকেন।

লাল কাঁকড়ার বিচরণ ও কেঁচোর আলপনা

লাল কাঁকড়ার মহড়ার অনিন্দ্য সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে

সৈকতের কোথাও কেঁচোর আলপনা, কোথাও ক্ষুদে লাল কাঁকড়ার অবাধ বিচরণ—এখন এমন দৃশ্যের দেখা মিলছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতেই। অথচ মানুষের পায়ের চাপে পুরো সৈকত রীতিমতো কার্পেটে পরিণত হয়েছিল! এখন জনশূণ্য সৈকতে মনোমুগ্ধকর আলপনা আঁকছে কেঁচো, তার পাশেই কাঁকড়ার দল। যেন অবচেতন মনের কোনো শিল্পীর ক্যানভাস সদৃশ এ দৃশ্য।

একসময় কক্সবাজার সৈকতে ছিল অসংখ্য খোলামেলা বালিয়াড়ি ও সারিবদ্ধ ঝাউবীথি। ভোরবেলায় বালিয়াড়িতে দেখা মিলতো লাল কাঁকড়ার ঝাঁক। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বালিয়াড়ির অসংখ্য গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতো লাখ লাখ কাঁকড়া। এখন সেগুলোতে গড়ে উঠেছে বড় বড় হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট। তারপরও যতটুকু জায়গা খালি আছে, এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে আগের সেসব দৃশ্য।

সেভ দ্যা নেচার অব বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান আ ন ম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, গত দেড় দশকে পর্যটক ও স্থানীয়দের অবাধ বিচরণে বিপন্ন হচ্ছিল এই সৈকতের প্রাণ ও প্রকৃতি। হুমকির মুখে ছিল জীববৈচিত্র্য। এখন সাগরলতা বেড়েছে। লাল কাঁকড়া দেখা যাচ্ছে দশগুণ বেশি।

লাল কাঁকড়া ও কেঁচোর চালচলন অনেকটা একই। নিরাপদ আশ্রয় পাবে বলে মনে হলে এরা বের হয়, শব্দ পেলে ছুটে পালায় নিরাপদে, ঢুকে পড়ে সৈকতের বালিতে নিজেদের তৈরি করা ঘরে (গর্তে)। আর সৈকতে গর্ত করে থাকা এদের পছন্দ। এই সময়ে সবসময়ই সৈকতে দেখা যাচ্ছে এদের। বিশেষ করে, লাল কাঁকড়ার মহড়ার অনিন্দ্য সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবেই।

ডলফিনের উচ্ছল নৃত্য ও শেষকৃত্য

কক্সবাজারের সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে ডলফিনের দেখা মেলে

কক্সবাজারে সৈকত ঘেসে ডলফিনদের খেলা করার বিরল দৃশ্য সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। মার্চের শেষের দিকে ১০ থেকে ১২টি ডলফিনের দলটির উচ্ছল নৃত্য সবাইকে মুগ্ধ করেছে। কলাতলী সমুদ্র সৈকতের একদম কাছেই ডলফিনগুলো খেলা করতে দেখা গেছে।

ডলফিনের খেলা করার দৃশ্য প্রথম ধারণ করা স্থানীয় সার্ফার মাহবুবুর রহমান বলেন, অতীতে তিনি কক্সবাজার সৈকতে ডলফিন খেলা করতে দেখেননি। কিন্তু বর্তমানে সৈকতে দর্শনার্থীদের পদচারণা না থাকায় ডলফিন মনের আনন্দে নীল জলে খেলা করছে বলেও জানান তিনি।

এক সপ্তাহ পর আর দেখা যায়নি সেই ডলফিনগুলোকে। এরপর ৩ ও ৪ এপ্রিল টেকনাফ উপকূলে ভেসে আসে অন্তত দুটি ডলফিনের মৃতদেহ। স্থানীয়রা বলছেন অন্যান্য সৈকতে আরও কয়েকটি মৃত ডলফিন সৈকতে দেখেছেন তারা। তবে কয়টি ডলফিন মারা গেছে এবং কীভাবে এগুলোর মৃত্যু হলো তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে।

/এন এইচ

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close