ভ্রমনশিক্ষা-সাহিত্য

নদীয়া ভারতের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ

মিঠুন সরকার, ভারতের নদীয়া থেকেঃ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন সংস্কৃত-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নদীয়া, রাজ্যের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা ঐতিহ্যবাহী শহর কৃষ্ণ নগর। পর্যটন ছাড়াও জেলার আয়ের প্রধান উৎস হল কৃষি। এই এলাকার প্রধান প্রধান ফসল গুলি হল – ধান, গম, তৈলবীজ, ডাল, আলু, সবজি, চাল ও আখ। নদীয়া জেলা শিল্পায়নের পরিপ্রেক্ষিতে একটি উন্নয়নশীল জেলা। প্রাচীন মন্দির, মসজিদ, ঐতিহাসিক দুর্গের উপস্থিতি এবং চমৎকার হস্তশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু নিয়ে সমৃদ্ধ নদীয়া জেলা একটি অসাধারণ পর্যটক গন্তব্য। জেলার সবচেয়ে বিখ্যাত জায়গা গুলি হল –

শ্রীধাম মায়াপুর পরমেশ্বর ভগবান শ্রীচৈতন্য দেবের অপ্রাকৃত জন্মস্থান। এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড়ো মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ ইস্কনের মূল কেন্দ্র। প্রতিবছর গৌর পুর্ণিমার সময় মায়াপুর ইস্কন মন্দিরে সারা বিশ্বের গৌর-কৃষ্ণ ভক্তের মহামিলন ঘটে। ইস্কনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল অভয়চরণারবৃন্দ এসি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ গুরু পরম্পরায় বৈষ্ণব আচার্য। তার প্রচেষ্টায় সারা পৃথিবীতে গৌরবানী প্রচারিত হয়েছে। ইস্কনের কার্যক্রমে বিভিন্ন দেশের মানুষ শ্রীচৈতন্যের ভক্তিবাদ গ্রহন করছে। মায়াপুর পর্যটক আকর্ষণীয় স্থান।

নবদ্বীপ – সনাতন (বৈষ্ণব) ধর্মের মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য দেবের লীলা প্রকাশের স্থান। এই শহর ভক্ত ও পর্যটকদের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ।

শান্তিপুর – একসময় সংস্কৃত শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এই শহর তার সুন্দর শাড়ির জন্য বিখ্যাত।

বল্লাল ঢিপী – একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।

পলাশী – এক ঐতিহাসিক যুদ্ধ স্থল যেখানে সিরাজ-উদ-দৌলা ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন।

শিবনিবাস – অন্য আরেকটি প্রাচীন মন্দিরের স্থান।

কৃষ্ণ নগর – পর্যটক আকর্ষণপূর্ণ এক ঐতিহাসিক শহর এবং বিস্ময়কর মৃন্ময় শিল্পকার্য দ্বারা সমৃদ্ধ। এটি জেলার সদর দপ্তর। আরও রয়েছে বাহাদুরপুর ফরেস্ট, বেথুয়াডহরি, মঙ্গলদ্বীপ চর,হাসানডাঙ্গা বিল।

কলকাতা থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর লোকালে উঠে কৃষ্ণনগর স্টেশনে নেমে মায়াপুরগামী বাসে উঠলে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছানো যায় নদীয়ার বামুনপুকুরে। আবার ট্রেনে হাওড়া থেকে নবদ্বীপ পৌঁছে ঘাট পেরোলে মায়াপুর থেকে বামুনপুকুরে আসা যায়। তবে এখানকার অন্যতম উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি হল চাঁদকাজীর সমাধি।

শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী গ্রন্থতে চাঁদকাজীর কথা উল্লেখ রয়েছে। এবং চাঁদকাজী কীভাবে চৈতন্যভক্ত হলেন সেই কাহিনীও রয়েছে। তবে এখানকার লোকেদের মত অনুযায়ী, চাঁদকাজী ছিলেন এই অঞ্চলের শাসক এবং গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের শিক্ষক। চাঁদকাজী শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ঘোর বিরোধী ছিলেন। এই চাঁদকাজী চৈতন্য দেবের সংকীর্তন বন্ধের আদেশ জারি করেন। এবং তিনি সংকীর্তনকারীদের খোল পর্যন্ত ভেঙে দেন। কিন্তু এই নিয়ম অমান্য করে শ্রীচৈতন্য বিরাট নাম সংকীর্তন দল নিয়ে চাঁদকাজীর বাড়িতে সংকীর্তন করতে থাকেন। এবং সেই দিনে সংকীর্তন শোভাযাত্রা করে চাঁদকাজীর বাড়িতে মহাপ্রভু এবং চাঁদকাজী তর্কযুদ্ধে বসেন। শেষে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্ত হয়ে যান।

কেবল ভক্ত নয়, তিনি চৈতন্যগত ভাবাদর্শে দীক্ষিত হয়ে যান। সমাধিক্ষেত্রতে ঢোকার সময়ে চোখে পড়ে উঁচু ইটের গাঁথুনি ও লোহার গেট যুক্ত মূল প্রবেশদ্বার। মূল প্রবেশদ্বারে বড় বড় অক্ষরে লিখিত রয়েছে “ভক্ত চাঁদকাজী সমাধি”। তবে সমাধিক্ষেত্রটি পরিচালনা করেন “মায়াপুর শ্রীচৈতন্য মঠ”। সমাধিটি চারিদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সমাধির উপরে দীর্ঘ বিশালাকার শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট প্রাচীন এক গোলকচাঁপা গাছ রয়েছে।

এখানকার লোকের বিশ্বাস, এই গোলকচাঁপা গাছটি নাকি চাঁদকাজীকে সমাধি দেওয়ার সময়েই লাগানো হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, গাছটি পাঁচশো(প্রতিষ্ঠা লিপিতে বর্ণিত আছে ছবিতে) বছরের প্রাচীন হলেও এখনও পর্যন্ত জীবিত রয়েছে, এবং ফুল ফুটে যাচ্ছে। আর গাছটি এতটাই প্রাচীন যে, গাছটির গোড়া দেখতে অনেকটা কুমীরের গায়ের মত (ছবিতে)। এই সমাধিকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা তীর্থ বলে মানেন।

নবদ্বীপ পরিক্রমা সময় ভক্তরা এই গাছের তলায় বসে চৈতন্য ভাগবত থেকে মহাপ্রভুর চাঁদকাজীর উদ্ধার লীলা পাঠ করেন। এখানকার পবিত্র ধূলিস্পর্শ করেন।

লেখক: সাংবাদিক।

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close