জীবন-যাপন
তুমি কোথায়? প্রশান্তি!
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক : চাপ আর চাপ। আর তার চিরসখা অস্থিরতা। এটাই তো এখন আমাদের জীবন। এর মধ্যে প্রশান্তি আবার কোন মহাশয়? কোথাও তার কোনো জায়গাই নেই। এ যুগ তো ইঁদুর–দৌড়ের। অনার্সে অল্পের জন্য ফার্স্ট ক্লাস ছুটে গেছে, মাস্টার্সে না পেলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ছেলের দুর্ঘটনার খবর হজম করেছি কি করিনি, পদোন্নতি হয়ে গেল পাশের টেবিলের সহকর্মীর। এমন সময়ে কেবলই মনে হতে থাকে, আমরা ক্রীতদাস এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার। মনকে চেপে ধরে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা। এ যুগে প্রশান্তি চপল–চরণ সোনার হরিণ। প্রশান্তি তো নিছক ফেসবুকে পাওয়া দশ মিনিটে চাপমুক্তির রেসিপি নয়। এ এক অটুট আবরণ। চাপ, উত্তেজনা আর অস্থিরতা থেকে যা আমাদের পুরো অস্তিত্বকে মুড়ে রাখে।
প্রশান্তির জন্য পাগলপারা খোঁজ আজকেরই নয়, ইতিহাসের সেই ধূসর অতীত থেকে। কে না এর খোঁজ করেছেন! ধর্মবেত্তা থেকে দার্শনিক, প্রত্যেকে। বৌদ্ধধর্ম বুঝতে চেয়েছিল সবার আগে। রাজ্যত্যাগী গৌতম বুদ্ধের সাধনাই ছিল দুঃখ থেকে চিরমুক্তি লাভ। বৌদ্ধধর্ম বলেছে পস্সদ্ধি বা প্রশান্তির কথা। এটি আসতে হবে শরীর–মন–চেতনার পথ ধরে, একযোগে। এরা হাত ধরাধরি করে না এলে তা প্রশান্তিই নয়। আসবে কোন পথে? জ্ঞানের রাস্তায়, জীবনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে, সামনে এগোনোর জন্য বিধান মেনে।
শরীর হলো খাঁচা, মন আর চেতনার। একে ঠিক রাখতে হবে আগে। সুষম আহারে, সুনিদ্রায়, সুস্থতায়। শরীর সুস্থ রাখার পথ এখন হাজারোটা। পাড়ায় পাড়ায় ব্যায়ামাগার, হালের ভাষায় জিম। ইয়োগা নামে ছিমছাম চেহারায় পশ্চিম থেকে হাতফেরতা হয়ে এসেছে আমাদেরই যোগব্যায়াম। আর সকালে বা সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরোলে তো শুধু শরীর নয়, মনটাকেও ফুরফুরে করে দেয় খোলা হাওয়া। ঘাসের সবুজ, লেকে সরের মতো শেওলা, ফেরিওয়ালার চাঙাড়িতে ফলের হরেক রং, চেনা মানুষের চকিত হাসি মেজাজ চনমনে করে দেয়।
ব্যস্ত দিনে সুগন্ধি কমিয়ে দিতে পারে মানসিক চাপ।
শরীরের পরে মন। মনের শুশ্রূষার পসরা বরং আরও বেশি। মনমতো শুধু খুঁজে নেওয়া। চারপাশে ছড়ানো কত না গল্প–কবিতা, গান, ছায়াছবি, খেলাধুলা! এসবের উপভোগে একদিকে নির্মল আনন্দ, আরেক দিকে উপরি পাওনা এই উপলব্ধি যে মানুষের জীবন বিচিত্র। হতাশা আর ব্যর্থতাই জীবনের শেষ সত্য নয়।
জার্মান মনোবিশারদ ফ্রিডরিখ কাম্বারটেল বলেছেন আরেকটি মূল্যবান কথা। বলেছেন, মনের শান্তি খানখান হয়ে যায়, যখন অন্যেরা হয়ে ওঠেন আমাদের মাপকাঠি। অন্যের প্রাপ্তি যদি আমার শান্তি নষ্ট করে দেয়, তার থেকে রেহাই কোথায়? এই শান্তি–অশান্তির নাটাই তো আর আমার হাতে নেই। তখনই তো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ঈর্ষা, বিদ্বেষ, ভয়। এমনকি যে রাগ নিতান্ত স্বাভাবিক এক আবেগ, সেটিও আমার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে প্রশান্তি হারিয়ে যায়। তাই সবার আগে জরুরি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ। এ পথ কঠিন। কিন্তু কঠিন এ পথের শেষেই অমৃতকুম্ভ।
বললাম, ধৈর্যের এ পথ বড় কঠিন। জাপানের নাওশিমা দ্বীপে এক আশ্চর্য পরীক্ষা হয়েছিল একবার আমাদের। শান্ত এই দ্বীপের পুরোটাই যেন শিল্প–জাদুঘর। জগদ্বিখ্যাত স্থপতি তাদাও আন্দো এখানে একজন শিল্পীর সঙ্গে রচনা করেছেন এক স্থাপত্য–শিল্পকর্ম। শামুকের মতো প্যাঁচানো সেই ভবনে ঢুকতে হলো ঘুরে ঘুরে, নিঃশব্দে। ঢুকছি, আর গাঢ়তর হচ্ছে অন্ধকার। কেন্দ্রে পৌঁছানোমাত্র আমাদের ডুবিয়ে দিল পিচের মতো অন্ধকার। চপলমতি আমাদের ফিসফিস প্রশ্ন, এত অন্ধকারে শিল্পকর্ম দেখব কী করে। গাইড বললেন, অপেক্ষা করতে হবে যে। চলল অপেক্ষা। দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে, আমাদের চোখের তলদেশ থেকে বাইরের আলোর শেষতম রেশটি মিলিয়ে যাওয়ার পর, দেয়ালে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল মৃদু নীল আলোয় রচিত সেই শিল্পকর্ম। তাদাও আন্দো আমাদের শেখান, আনন্দ মিলবে ধৈর্যের পথে।
আহ্ কী শান্তি! দিন শেষে এমন প্রশান্তি তো সবাই খোঁজে। মডেল: আজাদ। ছবি: কবির হোসেনচেতনার অবসাদের নিরাময় তো জীবনচর্চা। কেউ অন্তর্মুখী। বেছে নেন বাগানের চর্চা, প্রকৃতির সান্নিধ্য বা ধ্যানের পথ। কেউ আবার নিজেকে বিলিয়ে দেন মানুষের সমাজের বৃহত্তর জগতে। অন্যের সঙ্গে জীবনের যোগে মুক্তি খোঁজেন নিজের।
নিজেও অনেকে নিজের হতাশার উৎস, বলেছিলেন গ্রিক দার্শনিক সেনেকা। অনেকে জীবনের লক্ষ্য বদলান বারবার। অনেকে আবার একটিই কাজ করে চলেন জীবনভর, শেষ আর হয় না। দুইয়ের জীবনেই প্রশান্তি নেই। সেনেকার পরামর্শ, এমন একটি অর্থপূর্ণ কাজ বাছুন, যা এক জীবনে শেষ করে যেতে পারবেন। চেতনায় তা দেবে অপূর্ব প্রশান্তি।
বর্তমান দুনিয়া সফলতার জন্য নিরন্তর তাগিদের দুনিয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন, সফলতার চেয়ে সার্থকতার মূল্য বেশি। সফলতা দেয় গৌরব, কিন্তু সার্থকতা দেয় তৃপ্তি আর প্রশান্তি। কারণ সফলতা একার, সার্থকতার ভাগ অনেকের। একজন সার্থক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকও তাই প্রশান্তি পেতে পারেন, কিন্তু একজন সফল শিল্পপতি হয়তো নন। শীর্ষ ধনী ওয়ারেন বাফেট বা জনপ্রিয় তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মতো মানুষেরা তাই সফলতার পর মরিয়া হয়ে খোঁজেন সার্থকতার পথ। এমন পথ, যা তাঁদের জীবনকে মাধুরীময় করবে।
বিপ্লবের দর্শনগুরু কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে বেশি মানুষকে যে সুখী করতে পারে, সে–ই সবচেয়ে বেশি সুখী।’ যে কাজ চারপাশের মানুষের জীবনকে আনন্দময় করে, তার তৃপ্তি মানুষকে দেয় গভীরতম প্রশান্তি।
/আরএইচ