প্রধান শিরোনামব্যাংক-বীমা
টাকার মান কমাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ দীর্ঘদিন আটকে রাখার পর ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমাতে শুরু করেছে সরকার। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অনেকটা বাধ্য হয়েই এই কাজটি করা হচ্ছে।
এক দিনেই প্রতি ডলারে ১৫ পয়সা কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তঃব্যংক মুদ্রাবাজারে গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার এক ডলারের জন্য ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা দিতে হয়েছে। রোববার খরচ করতে হয়েছে ৮৪ টাকা ৬৫ পয়সা।
চীন, ভারত, ভিয়েতনামসহ প্রতিযোগী দেশগুলোর মতো রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের সুবিধা দিতে এই পথ বেছে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার বেশ খানিকটা শক্তিশালী হবে বলে আভাস দিয়েছেন ব্যাংকাররা।
‘দীর্ঘদিন ডলার-টাকার বিনিময় হার ধরে রাখা ঠিক হয়নি’ মন্তব্য করে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “অনেক পিছিয়ে গেছি আমরা। আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো বিশ্ববাজার দখল করতে তাদের মুদ্রার মান অনেক কমিয়েছে; আমরা করিনি। এখন আমাদের রপ্তানি আয় কমে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না।”
তিনি বলেন, “নগদ সহায়তা দিয়ে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব নয়। এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত। এই মুহূর্তে যেটা করতে হবে সেটা হল ডলারের বিপরীতে আমাদের টাকার মান কমাতে হবে। যে কাজটি আমাদের কমপিটিটর দেশ চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম প্রতিনিয়ত করছে। গতকালও (শনিবার) চীন তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে। আমাদেরও এখন সেই কাজটি করতে হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এক বছর আগে ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৩ টাকা ৮০ পয়সা। অল্প অল্প করে বেড়ে ২০১৯ সালের এপ্রিল শেষে তা ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা হয়।
এর পর থেকে টানা ছয় মাস টাকা-ডলারের বিনিময় হার ‘এই’ একই জায়গায় স্থির রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেশ বেড়ে গেছে। রোববার প্রতি ডলার ৮৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগেও খোলাবাজারে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বলেন, বেসরকারি অনেক বড় আমদানির দায় পরিশোধ হচ্ছে। এ কারণে অনেককে খোলাবাজার থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। তবে খোলাবাজারে সরবরাহ তেমন নেই। এতে দাম বেড়ে গেছে।
খোলাবাজারে ডলার আসে মূলত বিদেশফেরতদের কাছ থেকে। তাঁরা দেশে যে ডলার নিয়ে আসেন, তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন। মানি চেঞ্জারগুলোও বিদেশফেরত লোকজনের কাছ থেকে ডলার কিনে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকগুলোর কাছে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার দরে ৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-অগাস্ট) ডলারের তেমন চাহিদা ছিল না। সেপ্টেবরে বেড়েছে। চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে।
‘নানান কিছু বিবেচনায় নিয়ে’ টাকার বিপরীতে ডলারের বিপরীতে টাকাকে দুর্বল করতে দেয়া হচ্ছে বলে জানান ঐ কর্মকর্তা।
ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি খোলাবাজার ও মানি চেঞ্জারের লেনদেনও পর্যবেক্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পুরো জুলাই মাসে প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৩০ পয়সা দরে বিক্রি হয়। আগস্টে তা বেড়ে ৮৬ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত হয়। গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে কোনো কোনো দিনে প্রতি ডলার ৮৭ টাকায়ও বিক্রি করে মানি চেঞ্জারগুলো।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে ২৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ২৩১ কোটি ১০ লাখ ডলার সরবরাহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূলত: দুটি কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমছে। প্রথমত: ইউরোপের দেশগুলো আমাদের রপ্তানির প্রধান বাজার। সেখানে এক ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। সে কারণে সে দেশগুলোর মানুষ খরচ কমিয়ে দিয়েছে। পোশাকসহ অন্যান্য জিনিস কম কিনছে। তবে আমেরিকার অর্থনীতি চাঙ্গার কারণে সেখানকার বাজারে বাংলাদেশ ভালো করছে।
দ্বিতীয় কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, “আমাদের নিজস্ব সমস্যা আছে। সেটা হচ্ছে, উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ায়নি বায়াররা। প্রতিযোগী দেশগুলো বাজার ধরে রাখতে তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে; আমরা সেটাও করিনি। সবমিলিয়েই আমরা পিছিয়ে পড়ছি।”
“এবার টাকার ডিভ্যালুয়েশন বড় আকারে করতে হবে। তানাহলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যাবে না।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রোববার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৯৬৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। রপ্তানির এই অংক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ শতাংশ কম। আর গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে ৩ শতাংশ কম।