প্রধান শিরোনামবিশ্বজুড়েস্বাস্থ্য
চীনের ৭টি টিকার মধ্যে ৪টি টিকিই তৃতীয় পর্যায়ের আন্তর্জাতিক ট্রায়ালে
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ দুটো ভালো খবর। আগস্টের শেষ দিনে চীনের মূল ভূভাগে নতুন করে কেউ কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। বিগত কয়েক দিন ধরেই অবশ্য চিত্রটা একই। কোনো নতুন রোগী নেই (বিদেশ থেকে যে ক’জন রোগ নিয়ে আসছেন, তাদের কথা ভিন্ন)। আগস্টের শেষ দিন পর্যন্ত চীনের গোটা মূল ভূভাগে কনফার্মড রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২১৬ জন। দ্বিতীয় ভালো খবরটি হচ্ছে, মহামারিতে সবার আগে আক্রান্ত উহান শহরের ২৮৪২টি কিন্ডারগার্টেন এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ ছাত্র-ছাত্রী পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। উহানে এখন কোনো কোভিড-১৯ রোগী নেই।
উহানের মতো শাংহাই শহরেও মঙ্গলবারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন বছরের নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়েছে। একই দিনে ক্লাস শুরু হয়েছে সিছুয়ান, চিয়াংসু, কুয়াংতুং ও ইয়ুননান প্রদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। শাংহাইয়ের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের দেড় কোটি শিক্ষার্থীও পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থেকে পাঠ নেওয়া শুরু করেছে। শেনচেন শহরের ২৬২৮টি কিন্ডারগার্টেন এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলও একই দিনে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে উঠেছে।
রাজধানী বেইজিংয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাশ শুরু হতে যাচ্ছে আগামী ৭ সেপ্টেম্বর। আমার ছেলের মতো লাখ লাখ শিক্ষার্থী গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে শ্রেণিকক্ষে যেতে। একটি গোটা সেমিস্টার তারা অনলাইনে ক্লাশ করে কাটিয়েছে। এখন আবারও শ্রেণিকক্ষে ফেরার পালা। এর আগে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় গোটা চীনের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সিনচিয়াং ব্যতিক্রম। সাম্প্রতিক সংক্রমণের ঘটনার পর সেখানে অনলাইন শিক্ষা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এলে সেখানকার শিক্ষার্থীরাও ফিরে যাবে শ্রেণিকক্ষে।
এসব ভালো খবর। তবে আশঙ্কাও আছে। গরমের ছুটির আগে মাসখানেকের জন্য বেইজিংয়ের স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছিল পর্যায়ক্রমে। আকস্মিকভাবেই সিনফাতি মার্কেটের একজনের শরীরে ভাইরাস শনাক্ত হয়। ব্যস, যেসব স্কুল খুলেছিল, সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় এবং যেসব স্কুল খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেগুলো আর খোলেনি। এখন পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার পর স্কুলগুলো আবার খুলেছে ও খুলতে যাচ্ছে। আশঙ্কার কথা বলছি যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতার কারণে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাইরাসে আক্রান্তের হার বাড়ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের মহামারি পরিস্থিতির সঙ্গে চীনের পরিস্থিতির কোনো তুলনা চলে না, তথাপি সিনফাতির স্মৃতি এখনও অক্ষতই আছে। চীনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলছে এবং খুলছে কঠোর সাবধানতার সঙ্গেই। মহামারির পুনরাবির্ভাব ঠেকাতে নেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। উহানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের মাস্ক পরে যেতে হবে না; তবে সেখানে মাস্ক, সেনিটাইজার ইত্যাদির মজুত থাকবে। আবার বেইজিংয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে আপাতত। খোদা-না-খাস্তা, যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এক বা একাধিকে সংক্রমণ দেখা দেয়, তবে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় আবার ব্যঘাত ঘটবে। কারণ, আগের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, মহামারির প্রশ্নে চীন সরকার কোনো আপস করে না।
আসলে নভেল করোনাভাইরাসের বিচিত্র চরিত্র। এটি ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টায়। কেতাবি ভাষায় যাকে বলে মিউটেশান। একজন চীনা বিজ্ঞানী বলেছেন: “এই ভাইরাস খুবই স্মার্ট। এটি হয়তো সাধারণ ফ্লুর মতো আমাদের মাঝে থেকে যাবে।” কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস। পৃথিবীতে এ ধরনের আরও ভাইরাস টিকে আছে বহাল তবিয়তে। ফলে কোভিড-১৯ ভাইরাসের সঙ্গে সহাবস্থানই হয়তো মানবজাতির ভাগ্যলিখন। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ ডক্টর ফাউচি ও ডক্টর ডেবোরাহ বার্ক্স-এর মতো বিজ্ঞানীরাও একই ধরনের কথা বলছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র মন্তব্যও একইরকম। এদিকে, হংকংয়ে এমন একজন রোগী পাওয়া গেছে, যিনি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন এবং আবার আক্রান্ত হয়েছেন। প্রথমবার তিনি যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছেন তার চেয়ে ভিন্ন জিনোম সিকোয়েন্সের ভাইরাসে। সুস্থ হবার পর দ্বিতীয়বার ভাইরাসে আক্রান্তের খবর বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আসতে শুরু করেছে।
এ প্রেক্ষাপটে, বিশ্বব্যাপী টিকা আবিষ্কারের চলমান প্রতিযোগিতার গুরুত্ব তাই সহজেই অনুমেয়। কার্যকর একটি টিকাকেই কোভিড-১৯ ভাইরাসের মোকাবিলায় মানবজাতির মোক্ষম অস্ত্র মানছেন বিজ্ঞানীরা। এর মানে এই নয় যে, একটি কার্যকর টিকা হলেই এই ভাইরাস উধাও হয়ে যাবে। অনেক বিজ্ঞানী বলছেন, তেমন একটি কার্যকর টিকা মানুষকে ৬ মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত ভাইরাস থেকে বাঁচাতে পারবে। কেউ কেউ বুস্টার ডোজের কথা বলছেন। অর্থাৎ টিকা নিতে হবে একাধিকবার। আবার কেউ কেউ বলছেন, সাধারণ ফ্লুর টিকার মতো হয়তো এই ভাইরাসের টিকাও প্রতিবছর নিতে হতে পারে। কিন্তু এসব হচ্ছে পরের কথা; সবার আগে চাই একটি কার্যকর টিকা। বিশ্বে কয়েক ডজন টিকা নিয়ে গবেষণা করছে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, জার্মানি, চীন—কেউ বসে নেই। তবে, টিকা আবিষ্কারের দৌড়ে এগিয়ে আছে চীন।
অনেকেরই মনে আছে চীনের কুও ইয়াও গ্রুপের উদ্ভাবিত টিকার কথা। এই টিকা মানবদেহে প্রয়োজনীয় এন্টিবডি সৃষ্টি করেছিল সবার আগে। এ খবর আমরা জেনেছিলাম গত জুনের মাঝামাঝিতে। এর আগে এপ্রিলের ১২ তারিখে বিশ্বের প্রথম কোভিড-১৯ ভাইরাসের টিকা হিসেবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি পায় এটি। এর পর হোয়াং হ্য নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে।
চীনের ৭টি টিকা নির্ধারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সামনে এগিয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি ৪টি টিকা প্রবেশ করেছে তৃতীয় পর্যায়ের আন্তর্জাতিক ট্রায়ালে। বিশ্বের আর কোনো দেশের এতোগুলো টিকা বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়ালে নেই। চীনে যেহেতু মহামারি নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং হাতে গোনা কয়েকজন রোগী আছে, তাই টিকাগুলোর তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চীনে হওয়া সম্ভব না। কারণ, এ পর্যায়ে হাজার হাজার মানুষের শরীরে টিকার পরীক্ষা চালাতে হয়। তাই সবগুলো টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হচ্ছে বিদেশে।
চায়না ন্যাশনাল বায়োটেক গ্রুপ (সিএনবিজি)-এর দুটি টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে। এসব পরীক্ষায় প্রায় ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী অংশগ্রহণ করছেন। সিনোভ্যাক বায়োটেক কোম্পানি লিমিটেডের একটি টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে। কোনো টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী অংশগ্রহণ করেন। এই ট্রায়ালে টিকা কতোটা নিরাপদ ও কার্যকর তা নিরূপণ করা হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারও চীনা টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে।
দৃশ্যত চীন টিকা আবিষ্কারের দৌড়ে এগিয়ে আছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের মিডিয়ায় যথারীতি এ নিয়ে শুরু হয়ে গেছে সন্দেহ প্রকাশের খেলা। সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে চীনা টিকার কার্যকারিতা নিয়ে। তবে এটা নতুন নয়। চীনের সবকিছুতেই পাশ্চাত্যের মিডিয়া খুঁত খোঁজার চেষ্টা করে। মনে আছে. উহানে যখন মহামারি দেখা দিল তখনকার কথা। লকডাউনের সমালোচনা তো হয়েছেই, আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়েও নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করেছে পাশ্চাত্যের মিডিয়া। শুরুতে তারা বলেছে, অনেক বেশি লোক আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছে উহানে; চীন সরকার মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, ইত্যাদি। পরে যখন যুক্তরাষ্ট্রে হু হু করে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে লাগলো, তখন তারা বলতে শুরু করলো: ‘চীনে কেন এতো কম মানুষ আক্রান্ত হলো? এতো কম মানুষ মারা গেল? নিশ্চয়ই চীন সংখ্যা লুকাচ্ছে।’
কিন্তু পাশ্চাত্যের মিডিয়ার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব একসময় মিথ্যা প্রমাণিত হলো, চীন সফলভাবে মহামারি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হলো। চীনে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখও ছাড়ায়নি, মৃতের সংখ্যা ছাড়ায়নি পাঁচ হাজারের কোঠা। মৃতের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চীনের চিকিৎসাব্যবস্থা, বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী ওষুধের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু এ নিয়ে পাশ্চাত্যের মিডিয়ার কোনো বক্তব্য নেই। সিএনএন-এর কথা ধরুন। মহামারি নিয়ন্ত্রণে সফল দেশগুলোর কথা উঠলে তারা সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনামের কথা বলে, কিন্তু চীনের নাম মুখে আনে না। বিষয়টা আমাকে অবাক করে, সাংবাদিক হিসেবে লজ্জিতও করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে চীনের মডেল ফলো করেই এসব দেশ মহামারি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে!
পশ্চিমা মিডিয়ায় প্রচারণা থেমে নেই। সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে চীনের টিকা-গবেষণা নিয়ে। তবে, বিশ্বের বহু দেশ এই প্রচারণায় কান দিচ্ছে বলে মনে হয় না। তারা চীনা টিকা নিয়ে আশাবাদী। বাংলাদেশও তাদের দলে নাম লিখিয়েছে, দেরিতে হলেও। এতে দেশগুলো আখেরে লাভবান হবে, এমন আশা করাই যায়।
সেদিন সিএনএন-এর একটি নিউজ-রিপোর্টে টিকা-গবেষণা করছে এমন একটি চীনা কোম্পানির জনৈক কর্মকর্তার একটি সাউন্ড বাইট প্রচার করা হয়। উক্ত কর্মকর্তা বলেছেন: ‘আমাদের প্রতিযোগিতা ভাইরাসের সঙ্গে, একে অপরের সঙ্গে নয়। আমরা চাই সকল টিকা সফল হোক। বিশ্বের বিপুল চাহিদা মেটানো কোনো একটি কোম্পানির পক্ষে সম্ভব নয়।’ তিনি যথার্থ বলেছেন। চীন টিকা আবিষ্কারের দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে, এটা সত্য। তবে, মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি একটি কার্যকর টিকা, তা সে যে-দেশই আনুক। তারচেয়েও বেশি জরুরি আবিষ্কৃত টিকার বিশ্বায়ন। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। আশার কথা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
/এন এইচ