করোনাদেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
চলছে ‘অপারেশন কভিড শিল্ড’
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন কভিড শিল্ড’ চলমান রয়েছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও বিস্তৃতি রোধে প্রধানমন্ত্রীর যুদ্ধ ঘোষণার পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের নির্দেশনায় এ যুদ্ধে নিয়োজিত হন। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা জীবন বাজি রেখে জনগণের পাশে থেকে কাজ করছেন। ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে কর্মরত সেনা সদস্যদের মধ্যে গত সপ্তাহ পর্যন্ত এই ভাইরাসে তিন হাজার ৫৩৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন, আর প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন। দেশের এই ক্রান্তিকালে সেনাবাহিনীকে জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগের সুযোগ দেওয়ায় সেনাবাহিনীর সব সদস্যের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সেনাপ্রধান।
সেনা সদর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে সেনাবাহিনীর সব পদবির সদস্যের এক দিনের বেতনের পাশাপাশি সেনা কল্যাণ সংস্থা, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড, বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট লিমিটেড এবং ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের পক্ষ থেকে সর্বমোট ২৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়।
প্রথমে সেনাবাহিনীকে দুটি কোয়ারেন্টিন সেন্টার পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আশকোনা হজ ক্যাম্প ও উত্তরা দিয়াবাড়ী সংলগ্ন রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গত ১৯ মার্চ থেকে স্থাপন করা হয় দুটি কোয়ারেন্টিন সেন্টার। বিদেশফেরতদের প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিংয়ের পর নির্বাচিত যাত্রীদের বিমানবন্দর থেকে কোয়ারেন্টিন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া, ডিজিটাল ডাটা এন্ট্রি করা, কোয়ারেন্টিন সেন্টারে থাকাকালীন আহার, চিকিৎসা এবং অন্য আনুষঙ্গিক সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করে সেনাবাহিনী। বর্তমানে ঢাকার মহাখালীতে চালু হতে যাওয়া আইসোলেশন সেন্টারের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে সেনাবাহিনী।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের দেশের সব জেলায় সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা অনুযায়ী ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় গত ২৫ মার্চ থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা দিতে ৬২ জেলায় কাজ করছে সেনাবাহিনী। সেনা সদস্যরা প্রথম পর্যায়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত এবং বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টিনে থাকা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা দেন। এ ছাড়া বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের চিকিৎসা কার্যক্রমেও সহায়তা দেন। এখনো জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে সেনাবাহিনী বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের শহরগুলোয় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সাধারণ জনগণকে উৎসাহিত করছে। মোতায়েনের পর থেকে ঈদুল ফিতর পর্যন্ত ৬২টি জেলায় প্রায় সাত হাজার সেনা সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত দৈনিক গড়ে ৫৫০টি দল কাজ করেছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার সেনা সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত ৪৫০টি দল ৬২টি জেলায় কাজ করছে। শহর-গ্রাম ছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারা বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়সহ হাট-বাজারে সাধারণ মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে উৎসাহিত করছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে এসব সুরক্ষা সামগ্রী পর্যাপ্ত পরিমাণে বিতরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে জীবাণুনাশক ছিটানোর পাশাপাশি জীবাণুমুক্তকরণ টানেল স্থাপন করা হয়েছে।
জনজীবন স্থবির হয়ে পড়লে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজেদের উদ্বৃত্ত রেশন দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন। এখনো স্বল্প পরিসরে এ ত্রাণ বিতরণের কাজ চলছে। বিভিন্ন জেলায় কর্মহীন অসহায় মানুষের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আয়োজন করা হয়েছে ‘এক মিনিটের বাজার’, ‘সম্প্রীতির বাজার’ ও ‘সেনা বাজার’। ঈদুল ফিতরের আগে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, কাঁচা বাজার ছাড়াও এসব বাজারের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ঈদ উপহার হিসেবে জামা-কাপড় দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায় দুই লাখ ৮০ হাজার পরিবারের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া রোজার সময় অসহায় দুস্থ ও নিম্ন আয়ের পরিবারকে বিনা মূল্যে ইফতার দিতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল ‘সম্প্রীতির ইফতার’। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিজস্ব ও সরকারি ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসামরিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ত্রাণসামগ্রীও বিতরণ করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর আর্মি এভিয়েশন গ্রুপ নিয়মিতভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসহায় ও দুস্থ মানুষের সহায়তায় ত্রাণসামগ্রী ও সেনানিবাসগুলোর জন্য জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। বেসামরিক প্রশাসনের অনুরোধে আর্মি এভিয়েশনের হেলিকপ্টারযোগে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জরুরি পরিস্থিতিতে সহায়তা দিতে আর্মি এভিয়েশন গ্রুপের তিনটি এমআই হেলিকপ্টার ও একটি কাসা সি-২৯৫ বিমান সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে জরুরি রোগী পরিবহনে সেনাবাহিনীর আরো দুটি হেলিকপ্টারে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সের সুবিধাদি যুক্ত করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
প্রান্তিক কৃষকদের সহায়তায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সরাসরি তাঁদের কাছ থেকে ন্যায্য দামে সবজি কেনা হয়। সেনা সদস্যরা নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি ত্রাণসামগ্রী হিসেবে এসব সবজি প্রায় ১৭ হাজার অসহায় ও দুস্থ পরিবারের মধ্যে বিতরণ করে। এ ছাড়া ২৪ হাজারের বেশি গরিব কৃষকের মধ্যে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে বিভিন্ন ধরনের কৃষি বীজ বিতরণ করা হয়।
এ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ৩৮ হাজার ২৭৯ জন অসহায় ও দুস্থ মানুষকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও জরুরি ওষুধ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের অংশ হিসেবে গত ৯ জুন থেকে ৯ জুলাই এক মাসব্যাপী সেনাবাহিনী নিজ নিজ দায়িত্বরত এলাকায় গর্ভবতী মায়েদের বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা, বিনা মূল্যে ওষুধ এবং উপহার সামগ্রী দিয়েছে। মাসব্যাপী এ কার্যক্রমে উপকৃত হয়েছেন ১৩ হাজার ৬৬৪ জন গর্ভবতী মা। করোনাভাইরাসের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ায় ৫৯ জন গর্ভবতী মায়ের নমুনা পরীক্ষা করে তিনজনের করোনা শনাক্ত হলে তাঁদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পরামর্শ দেন সেনা চিকিৎসকরা।
এ ছাড়া দুই হাজার ৮৮৪ জন গর্ভবতী মায়ের রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। এর পাশাপাশি করোনায় আক্রান্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা সিএমএইচসহ সব সেনানিবাসের সিএমএইচে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর প্রাধিকৃত সদস্য ও তাঁদের পরিবারের করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজিতে তিনটি এবং অন্যান্য সেনানিবাসে অবস্থিত সিএমএইচগুলোতে ১০টি আরটি-পিসিআর মেশিন স্থাপন করা হয়। সিএমএইচগুলোতে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও সরকারের নির্দেশক্রমে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা করোনাকালীন চিকিৎসা নিচ্ছেন।
/আরএম