দেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
চকবাজারে শুধু ইফতার নয়, ঐতিহ্যে মোড়া ভালোবাসা
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: রাজধানীর ইফতার মানেই চকবাজারের ঐতিহ্য। মুঘল আমল থেকে চলে আসা চকবাজারের ইফতার ঐতিহ্য আর চকবাজারে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীজুড়ে। বাহারি ইফতারির পসরা সাজানো এ স্থানটি বৈচিত্র্য আর ভিন্ন স্বাদের জন্য পুরো রাজধানীতে বিশেষভাবে সমাদৃত। নানা স্বাদের মুখরোচক খাবারের মনকাড়া সুবাস চারদিকে। পুরান ঢাকার চকের ইফতারির বাজারের সেই পরিচিত দৃশ্য। এ এক অন্যরকম আমেজ।
ইতিহাসবিদদের মতে, ঢাকার বয়সের সমান চকবাজারের ইফতারির বাজার। তাদের মতে, ১৭০২ সালে ঢাকার দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খাঁ চকবাজারকে আধুনিক বাজারে পরিণত করেন। তখন থেকেই প্রতি রমজানে চকবাজারে জমকালো ইফতারি বাজার বসে। সেই থেকে আজও তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে। সম্প্রতি চকের ঐতিহ্য যেন আরো বেড়েছে। চার শ’ বছরের পুরনো হলেও চকবাজারের ইফতারের নামডাক ছিল সব সময়। এখনকার ইফতার সামগ্রীও উৎকৃষ্ট মানের। বংশ পরম্পরায় তৈরি হয় চকের ইফতারি।
চকবাজারের মর্মান্তিক ট্রাজেডির ক্ষত কাটিয়ে উঠে ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। এবার চকবাজারের চারদিকে কয়েক শত ইফতারির দোকান বসেছে। এসব দোকানে বিশাল শিকের সঙ্গে জড়ানো সুতি কাবাব, জালি কাবাব, শাকপুলি, টিকা কাবাব, ডিম চপ, কাচ্চি, তেহারি, মোরগ পোলাও, কবুতর ও কোয়েলের রোস্ট, খাসির রানের রোস্ট, দইবড়া, মোল্লার হালিম, নূরানী লাচ্ছি, পনির, বিভিন্ন ধরনের কাটলেট, পেস্তা বাদামের শরবত, লাবাং, ছানামাঠা, কিমা পরোটা, ছোলা, মুড়ি, ঘুগনি, বেগুনি, আলুর চপ, জালি কাবাব, পিঁয়াজু, আধা কেজি থেকে ৫ কেজি ওজনের জাম্বো সাইজ শাহী জিলাপিসহ নানা পদের খাবার সাজিয়ে বসে পড়েছেন বিক্রেতারা। এছাড়া আতা, আনারস, আম, মালটা, খেজুরসহ বিভিন্ন ধরনের ফল, ঘোল, পিঠা-পায়েস, মিষ্টিসহ ইফতারের নানা সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে এ বাজারে।
এ ছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য খাবারের মধ্যে খাসির কাবাব, গরুর কাবাব, খাসির রানের রোস্ট, দেশি ছোট মুরগি রোস্ট, কবুতরের রোস্ট, কোয়েলের রোস্ট, চিকন জিলাপি, বড় শাহী জিলাপি, দইবড়া, চিকেন স্টিক, জালি কাবাব, বিফ স্টিক, কিমা পরোটা, টানা পরোটা, হালিম, ডিম চপ, সমুচা, পনির সমুচা, পিঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে।
চকবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ঐতিহ্যবাহী ইফতার ‘বড়বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গা ভইরা লইয়া যায়’ আগের ইমেজ অনেকটাই হারিয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই খাবারের মান যেমন আগের চেয়ে কমেছে, তেমনি হেরফের ঘটে গেছে স্বাদে। এসব কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং এই খাবার তৈরির উদ্যোক্তারা। তারা জানান, বংশগতভাবে দীর্ঘদিন ধরে এই জায়গায় ইফতারির ব্যবসা করছেন তারা। তাদের বাবা, দাদা, তার বাবারও এখানে ইফতারি সামগ্রী বিক্রি করতেন। ঐতিহ্য ধরে রাখতেই তাদের এই ব্যবসা। তবে এখন অনেকেই নতুন নতুন এসেছেন বলেও জানান তারা। বড়বাপের পোলায় খায় ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায় আইটেমের পরে যে নাম আসে তা হলো চকবাজারের শাহি জিলাপি। এক থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত ওজন হয় একেকটি শাহি জিলাপির। সরেজমিনে দেখা যায়, দোকানিরা বৈচিত্র্যে ভরপুর ঐতিহ্যবাহী ইফতার সামগ্রী থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন টেবিলে। রয়েছে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। রাস্তার ওপর বসা চকবাজার ইফতারির দোকানে মাথার ওপর নানা রঙের শামিয়ানা। চারদিকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের হৈ-হুল্লোড় আর হাঁকডাক।
বিক্রেতারা জানান, পুরান ঢাকার বাসিন্দারা বাড়ির তৈরি ইফতারির চেয়ে দোকানে তৈরি ইফতারি দিয়েই ইফতার করতে অভ্যস্ত। যে কারণে পুরো রমজান জুড়েই চকের ইফতারির বাজার থাকে সরগরম। তবে শুধু পুরান ঢাকার বাসিন্দারাই নন, রাজধানীর অন্যান্য এলাকার বাসিন্দারাও রমজানে চকবাজার থেকে ইফতার সামগ্রী কিনতে আসেন।
ঐতিহ্যের শহর ঢাকা আর ঢাকার প্রসিদ্ধতম ঐতিহ্য সমূহের একটি চকের ইফতার বাজার। মানুষের আগ্রহ এবং ভালোবাসার জন্যই মূলত এত বিখ্যাত এই ইফতার বাজার। ধনী গরিব সবারই এক পছন্দের জায়গা এই ইফতার হাট। অটুট থাকুক চকের ইফতার ঐতিহ্য, অটুট থাকুক একে ঘিরে গড়ে উঠা ভালোবাসা আর সম্প্রীতির উদাহরণ।