কৃষিপ্রধান শিরোনামবিশেষ প্রতিবেদন

কৃষিভিত্তিক সরকারি টিভি চ্যানেল চালু করতে যাচ্ছে সরকার

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ কৃষিভিত্তিক একটি টেলিভিশন চ্যানেল চালু করতে যাচ্ছে সরকার। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এই টিভির সম্প্রচার করা হবে। একইসঙ্গে দুর্গম বিবেচনায় সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল এবং নোয়াখালীর সুবর্ণচরে চালু করা হবে দুটি কৃষিভিত্তিক কমিউনিটি রেডিও।

কৃষি মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, এই স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের প্রাথমিকভাবে নাম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘কৃষি টিভি’। এটি ২৪ ঘণ্টাই কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে। এই চ্যানেলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে কৃষি তথ্য সার্ভিস। সব প্রোগ্রাম তৈরি করবে তারা, তবে সম্প্রচারের কারিগরি দিকটি দেখবে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএসসিএল)।

আগামী অর্থবছর থেকে চ্যানেলটি চালুর চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বিসিএসসিএল এগোচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা জানিয়েছেন, কৃষি বিভাগের তরফে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেই তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্প্রচারে যেতে পারবেন।

কৃষি ঐতিহ্যকে ধারণ করে এই চ্যানেলের মাধ্যমে কৃষি তথ্য তুলে ধরা, কারিগরি পরামর্শসহ কৃষককে নানাভাবে সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করা হবে। কৃষকের জন্য বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানও থাকবে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

অপরদিকে বর্তমানে বরগুনার আমতলীতে কৃষিভিত্তিক একটি কমিউনিটি রেডিও রয়েছে। সুনামগঞ্জের দুর্গম হাওরাঞ্চল ও নোয়াখালীর চরাঞ্চলেও কৃষিভিত্তিক কমিউনিটি চালুর বিষয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই দুটি রেডিও চালু করা হলে ওই অঞ্চলের কৃষি উন্নয়নে তা ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, ‘বরগুনায় কৃষিভিত্তিক একটি কমিউনিটি রেডিও রয়েছে। আমরা আরও দুটি রেডিও করতে চাই। একটি সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে আরেকটি নোয়াখালীর সুবর্ণচরে।’

তিনি বলেন, ‘কৃষি টেকনোলজি এবং কোনো একটি ফসল চাষ বা ফলের গাছ লাগাতে কী কী করতে হবে—এই ইস্যুগুলো আমরা টেলিভিশনে তুলে ধরতে চাই। এতে কৃষক আরও এগিয়ে যাবে।’

কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, ‘কৃষিভিত্তিক একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশন করার প্রকল্প আমাদের রয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এই টেলিভিশন চ্যানেলটি সম্প্রচারে আসবে। প্রকল্পটি এখনো প্রক্রিয়াধীন আছে, এটি এখনো পাস হয়নি। এটি নিয়ে একটি পর্যালোচনা সভা হয়েছে। সেখানে কিছু পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছিল, সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।’

তিনি বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটা এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) স্বাক্ষর করব। খসড়া প্রস্তুত করা হচ্ছে। খুব ভালো একটা কাজ হবে এটা। কৃষির সার্বক্ষণিক প্রচারের জন্য কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দেখানোর জন্য টিভি চ্যানেলটি কাজ করবে। আপাতত আমরা এর নাম বলছি ‘কৃষি টিভি’।

প্রাথমিক চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী এই টিভি চ্যানেল ২৪ ঘণ্টাই সম্প্রচারে থাকবে জানিয়ে পরিচালক বলেন, ‘কৃষি হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। এই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে, কৃষির অগ্রগতিকে ধারণ করে কৃষি টিভির মাধ্যমে কৃষককে কারিগরি পরামর্শ, প্রযুক্তিগত সহায়তাসহ নানা সহায়তা দেয়ার চেষ্টা আমরা করব। কৃষকের বিনোদনের ব্যবস্থাও থাকবে কৃষি টিভিতে। কৃষিকে কেন্দ্র করেই এই টিভি পরিচালিত হবে।’

‘এ সংক্রান্ত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এটি পরিকল্পনা কমিশনে যাবে। টেলিভিশন চ্যানেলটি আগামী অর্থবছরে চালু করার ইচ্ছা আছে আমাদের’—বলেন কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী।

এআইএসের তথ্য অফিসার মোহাম্মদ জাকির হাসনাৎ বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করে একটি কৃষিভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ স্যাটেলাইট চ্যানেল করতে চাই। বাংলাদেশে এখনো এ ধরনের কোনো টেলিভিশন চ্যানেল নেই। যদিও আমরা বিটিভিতে কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান করছি, সংসদ টিভিতেও অনুষ্ঠান করেছি।’

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের এটা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মিটিং হয়েছে। তারাই মূলত আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে। সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। আমাদের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন নিতে হবে। এরপর কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব যাবে তথ্য মন্ত্রণালয়ে।’

‘টেলিভিশন মিডিয়ার তো ব্যাপক একটা ইমপ্যাক্ট আছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এখন বিভিন্ন চ্যানেলে কৃষিভিত্তিক প্রোগ্রাম যায়, সেটা কৃষকের জন্য সঠিক সময় নাও হতে পারে। কৃষকের জন্য উপযোগী প্রোগ্রামটাও হয়তো নাও যেতে পারে। একটা ডেডিকেটেড চ্যানেল থাকলে সেখানে এই সমস্যাগুলো হবে না। এখানে কৃষিভিত্তিক কার্যক্রম, অনুষ্ঠানমালা, সংবাদ, সরকারের কৃষিভিত্তিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রমও যাবে। আর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আমাদের গর্ব, এর সুবিধাটাও আমরা নিতে চাইছি। খুব কম খরচে আমরা এটা করব।’

চ্যানেল পরিচালনার ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল বিষয়টি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কর্তৃপক্ষ নিজেরাই নিয়েছে জানিয়ে জাকির হাসনাৎ বলেন, ‘তারা আমাদের কাজ হালকা করে দিয়েছে। আমরা প্রোগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকব, প্রোগ্রামগুলো আমরা তৈরি করে দেব। স্যাটেলাইট কর্তৃপক্ষ এটা সম্প্রচার করবে। প্রাথমিকভাবে নিজেরা প্রোগ্রাম তৈরির পাশাপাশি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমেও প্রোগ্রাম নেয়া হবে।’

কৃষি নিয়ে ভাবেন এমন বরেণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি করার পরিকল্পনা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের সুপারিশ আমরা শুনব, সেই অনুযায়ী চ্যানেলের কার্যক্রম পরিচালনা করব।’

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণকারী বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএসসিএল) চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ‘(কৃষিভিত্তিক টিভি চ্যানেল করার জন্য) আমরা সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত আছি। লাইসেন্স নেয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে আমরা সম্প্রচারে যেতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয় প্রোগ্রাম প্রস্তুত করে আমাদের দেবে। সেটা আমরা নিয়ে গাজীপুর থেকে সব জায়গায় ছড়িয়ে দেব। এখনো এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি হয়নি। আমি এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের দিকের কাজ সম্পন্ন করলেই হবে। আমরা রেডি আছি, একটি চ্যানেল রেডি করাই আছে।’

হাওর ও চরে কমিউনিটি রেডিও কৃষি তথ্য সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কৃষি রেডিও এফএম ৯৮.৮ কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন একমাত্র সরকারি কমিউনিটি রেডিও। এর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় রয়েছে কৃষি তথ্য সার্ভিস ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এটি দক্ষিণাঞ্চলের সাগরকন্যা বরগুনার আমতলীতে রয়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত এ রেডিওটি ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি সম্প্রচার শুরু করে। বর্তমানে প্রতিদিন আট ঘণ্টা করে কমিউনিটির শ্রোতাদের চাহিদা অনুযায়ী ভিন্ন আঙ্গিকে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ২ ঘণ্টা, বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টা—মোট আট ঘণ্টা অনুষ্ঠান প্রচার হয়। কৃষি রেডিও থেকে মোট ২৫টির মত অনুষ্ঠান বিভিন্ন আঙ্গিকে সম্প্রচারিত হয়।

মূলত কমিউনিটির জনগণ অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, নির্মাণ এবং সম্প্রচারে সম্পৃক্ত থেকে কৃষি রেডিওর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কৃষি রেডিও’র শ্রোতাক্লাবের সংখ্যা ২৫টির মতো। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী কৃষি রেডিও’র শ্রোতার সংখ্যা ৭৫ হাজারের কম নয় বলেও জানিয়েছে এআইএস।

এআইএসের তথ্য অফিসার মোহাম্মদ জাকির হাসনাৎ বলেন, ‘সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা ও নোয়াখালীর সুবর্ণচরে কমিউনিটি রেডিও স্থাপনের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। হাওর সবসময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে, হঠাৎ বন্যা এসে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। সেখানে সাধারণ যোগাযোগও কষ্টকর। এজন্য সেখানে রেডিও থাকলে দ্রুত যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। সেজন্যই সেখানে একটি কমিউনিটি রেডিও আমরা করব। সুবর্ণচরেও একই অবস্থা। তাই সেখানেও একটি কমিউনিটি রেডিও করব আমরা। মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেয়া হয়েছে।’

৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে একটি কমিউনিটি রেডিও’র সম্প্রচার হয়ে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কমিউনিটির লোকজনই সেটা পরিচালনা করে। তাই এই রেডিও বেশ কার্যকর বলেই আমরা মনে করি। ওই সব এলাকায় দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে ফসল রক্ষার জন্য এই রেডিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আমরা মনে করি।’

/এন এইচ

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close