দেশজুড়ে
কী হবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে আইনিভাবে ধোঁয়াশায় রয়েছে খোদ নির্বাচন কমিশন (ইসি)। করোনা সংক্রমণের কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ৩৭১টিসহ নির্বাচন উপযোগী দেশের সব ইউপির ভোট কতদিন আটকে রাখা যাবে, আইনে তা স্পষ্ট নয়। সময় মতো ভোট না হলে বিদ্যমান পরিষদ সর্বোচ্চ ৯০ দিন কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে বিধান থাকলেও এর পরে কী হবে, আইনে তা খোলাসা করে বলা হয়নি। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আইনের স্প্রিট হচ্ছে— নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করা। ভোট না হলে আইনের লঙ্ঘন হবে না বলেও তারা মনে করেন। এক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিষদকেই কার্যক্রম চালিয়ে নিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিতে পারবে।
অবশ্য আইনে বিষয়টির স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় নির্বাচন কমিশন নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তাভাবনা করছে। ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থগিত এবং নির্বাচন উপযোগী অন্যান্য নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী ১৯ মে কমিশন সভা ডেকেছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত ১ এপ্রিল কমিশনের সভায় ১১ এপ্রিলের ইউপি ভোট অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দেয়। ইউনিয়ন পরিষদ আইন-২০০৯ এর ২৯(৩) অনুযায়ী, নির্বাচন করা সম্ভব হবে না বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি আইনের ২৯(৫) ধারা অনুযায়ী, পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টিও জানানো হয়।
জানা গেছে, ইসির চিঠি পাওয়ার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে আইনের ২৯(৫) ধারার বিধান অনুযায়ী, বিদ্যমান ইউনিয়ন পরিষদকে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইনের এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘দৈব-দুর্বিপাকজনিত বা অন্যবিধ কোনও কারণে নির্ধারিত ৫ (পাঁচ) বছর মেয়াদের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে, সরকার লিখিত আদেশ দিয়ে, নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত কিংবা অনধিক ৯০ দিন পর্যন্ত, যা আগে ঘটবে, সংশ্লিষ্ট পরিষদকে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ক্ষমতা প্রদান করতে পারবে।’ সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মেয়াদ শেষে বিদ্যমান পরিষদগুলোর সর্বোচ্চ ৯০ দিন দায়িত্ব পালনের সুযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১১ এপ্রিলের ভোট স্থগিতের পর নির্বাচন কমিশন পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে নতুন করে কোনও আলোচনা হয়নি। লকডাউনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন তার মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে দুই দফায় জুম মিটিং করলেও কোনও মিটিংয়ের এজেন্ডায় বিষয়টি ছিল না। এ নিয়ে কোনও কমিশনার বা কর্মকর্তারাও কথা বলেননি। তবে আগামী বছরের বাজেটে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য বরাদ্দ রাখার বিষয়ে বৈঠকে কথা হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে ইসির সূত্র বলছে, গত ১২ মে লকডাউনের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ইসি সচিবালয়ের কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা অফিস করেছেন। এদিন তারা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে ইউনিয়ন পরিষদসহ অন্যান্য নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। আইনি বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করেন। পরে সব নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তারা ১৯ মে কমিশন সভার সিদ্ধান্ত নেন।
স্থানীয় সরকার পরিষদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের হিসাব পরিষদের মেয়াদের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন পূরবর্তী নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত। নির্বাচন বিষয়ে আইনের ২৯ (৩) ধারায় বলা আছে— ‘পরিষদ গঠনের জন্য কোনও সাধারণ নির্বাচন ওই পরিষদের জন্য অনুষ্ঠিত পূর্ববর্তী সাধারণ নির্বাচনের তারিখ হতে ৫ (পাঁচ) বছর পূর্ণ হওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।’ অর্থাৎ বর্তমান পরিষদের নির্বাচন যে তারিখে হয়েছে, তা হতে ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে নতুন ভোট হতে হবে।
এ হিসেবে তফসিল ঘোষিত ৩৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়াও দেশের সাড়ে ৪ হাজার ইউনিয়ন পরিষদের বেশির ভাগেরই ভোটের সময় পার হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ২২ মার্চ প্রথম দফায় ৭২৫টি, ৩১ মার্চ ৬৪৪টি, ২ এপ্রিল ৬১৫টি, ৭ মে ৭০৩টি, ২৮ মে ৭১৮টি এবং ৪ জুন ৬৯৯টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই হিসাবে বেশিরভাগ ইউপির নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় পার হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘এখানে যেহেতু অনধিক ৯০ দিনের কথা বলা আছে, এর অর্থ ৯০ দিনের বেশি যাওয়ার সুযোগ নেই। আর এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন না-হলে তার বিধান কী হবে, তার জন্য ব্যাখ্যা প্রয়োজন। তবে বিষয়টি যেহেতু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের, তারাই সিদ্ধান্ত নেবে।’
নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব ফরহাদ আহম্মেদ বলেন, ‘নির্বাচন পরিচালনার জন্য মেয়াদ শেষে সর্বোচ্চ ৯০ দিন পরিষদ পরিচালনার কথা রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে যেহেতু প্রশাসক নিয়োগের বিধান নেই, ফলে বিদ্যমান পরিষদই এই সময়টা পরিচালনা করবে। কিন্তু পরবর্তীতে ভোট বা পরিষদ পরিচালনার বিষয়ে কী হবে, তা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘আইনের স্পিরিট হচ্ছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোট করতে হবে। অবশ্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোট না হলে আইনের ব্যত্যয় হবে না বলে মনে হয়।’
তিনি জানান, অন্যান্য পরিষদের ক্ষেত্রে প্রথম বৈঠকের তারিখ ধরে ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ববর্তী ৯০ দিন বা ১৮০ দিনের মধ্যে ভোট করার কথা, কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন থেকে ৫ বছর পূর্তির পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে ভোট করতে হবে। এই হিসাবে ইতোমধ্যে বেশিরভাগ ইউনিয়ন পরিষদের ভোটের নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেছে বলে তিনি জানান।
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আইনে যেহেতু কোনও বিধান নেই, ফলে বর্তমান পরিষদই এটা চালিয়ে নিয়ে যাবে। কারণ, পরিষদ তো বিলুপ্ত করা যাবে না।’
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যথাসময়ে নির্বাচন না হলে আইনের ব্যত্যয় হবে কিনা, তা আইনের ব্যাখ্যা ছাড়া বলা সম্ভব নয়। আইনে বলা আছে— ভোট না হলে আগের পরিষদ দিয়ে কার্যক্রম চালাতে হবে। এখানে কোনও লিমিট দেওয়া নেই।’
ভোটের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন কার্যত একটি ইমার্জেন্সির মধ্যে রয়েছি। এই অবস্থায় তো কোনও কিছু করার সুযোগ নেই। হয়তো ঈদের পর অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। ইমার্জেন্সি না থাকলে আমাদের তো ভোট করার বাধ্যবাধকতা থেকে যায়। দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে করোনা সংক্রমণের মধ্যেও ভোট হয়েছে। আইনের বাধ্যবাধকতায় আমাদেরও হয়তো করতে হবে। ঈদের পরে অবস্থার পরিবর্তান হতে পারে। তখন লডডাউন না থাকলে আমরা বসে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো।’
যথা সময়ে নির্বাচন না হলেও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে আইনগতভাবে কোনও সমস্যা হবে না বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (ইউনিয়ন পরিষদ শাখা) মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী। তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের ভোট না হলেও আইনি কোনও জটিলতা হবে না। ভোট করা সম্ভব না হলে কী হবে, তার সমাধান ইউনিয়ন পরিষদ আইনেই উল্লেখ হয়েছে।’
তিনি আইনের ১০১ নম্বর ধারাটির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘নির্বাচন বা অন্য কোনও ইস্যুতে সমস্যা হলে আমরা আদেশ জারি করে তার সমাধান করতে পারবো।’ এক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিষদগুলোই তাদের দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে বলেও তিনি জানান।
প্রসঙ্গত, ‘ইউনিয়ন পরিষদ আইন ২০০০’ এর ১০১ ধারায় আইনের অসুবিধা দূরীকরণের বিষয়ে বলা হয়েছে— ‘এই আইনের বিধানবলী কার্যকর করবার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা দেখা দিলে সরকার, উক্ত অসুবিধা দূরীকরণার্থে, আদেশ দ্বারা, প্রয়োজনীয় যে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।’
/একে