শিক্ষা-সাহিত্য
কারিগরি শিক্ষার পরও এক বছর বেকার থাকছে ৭৫%
কারিগরি শিক্ষার্থীদের যেসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার শেখানো হচ্ছে, তা গত শতাব্দীর
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ লক্ষ্মীপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৭ সালে কারিগরি শিক্ষা শেষ করেন সজীব আহমেদ। এর পর থেকেই চাকরির চেষ্টা করছেন। প্রায় দুই বছর ধরে চেষ্টা করেও চাকরি হয়নি আর্কিটেকচার অ্যান্ড ইনটেরিয়র টেকনোলজি বিষয়ে এ সনদধারীর।
কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৭ সালে ইলেকট্রিক্যাল বিষয়ে পড়ালেখা সম্পন্ন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিজাম উদ্দিন। সেই থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করেছেন, কিন্তু সুযোগ হয়নি। এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজাম উদ্দিন।
কারিগরি শিক্ষা শেষ করার পরও বেকার থাকছেন সজীব ও নিজাম উদ্দিনের মতো অনেক তরুণ। বিশ্বব্যাংকের জরিপ বলছে, দেশে কারিগরি ডিগ্রি সম্পন্নের পর এক বছর পর্যন্ত বেকার থাকছেন ৭৫ শতাংশ পলিটেকনিক ডিগ্রিধারী। আর দুই বছর পর্যন্ত বেকার থাকেন ৩২ শতাংশ।
দক্ষতার ঘাটতিকেই এর প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কারিগরি শিক্ষার্থীদের যেসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার শেখানো হচ্ছে, তা গত শতাব্দীর। শিল্প-কারখানা এসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার বন্ধ করে নতুন প্রযুক্তি আনছে। শিল্পের উপযোগী আধুনিক জ্ঞান তৈরি না হওয়ায় নিয়োগদাতারা চাকরিপ্রার্থীদের ওপর সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। অধিকতর শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের জন্যও সময় নিচ্ছেন অনেকে।
যদিও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারিগরি শিক্ষাকে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থী অংশগ্রহণের হারও এখন ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে। আগামী ১০ বছরে এ হার দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থান ও দক্ষতা যাচাইয়ে কয়েক বছর ধরে ‘গ্র্যাজুয়েট ট্রেসার স্টাডিজ’ শীর্ষক জরিপ চালিয়ে আসছে বিশ্বব্যাংক। সর্বশেষ জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন গতকাল প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। সেখানে কারিগরি শিক্ষার মান, পলিটেকনিক গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা ও কর্মবাজারের প্রস্তুতি বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এ চিত্রকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
জরিপের তথ্য বলছে, পাস করে বের হওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় বেকার থাকতে হয় এমন গ্র্যাজুয়েটদের বেশির ভাগই কারিগরির। কারিগরির ৭৫ শতাংশ গ্র্যাজুয়েটই এক বছরের বেশি সময় বেকার থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে এ হার ২০ ও কলেজের ৩০ শতাংশ। আর দুই বছরের বেশি সময় বেকার থাকেন এমন গ্র্যাজুয়েটদের হার সবচেয়ে বেশি কলেজের। কলেজ গ্র্যাজুয়েটদের ৪৬ শতাংশ দুই বছরের বেশি সময় পর্যন্ত বেকার থাকেন। একই সময় পর্যন্ত বেকার থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬ ও কারিগরির ৩২ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট।
মানসম্মত শিক্ষা না পেলে কারিগরি গ্র্যাজুয়েটরা চাকরির বাজারে ভালো না করাটা স্বাভাবিক বলেই মনে করেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) উপাচার্য অধ্যাপক আবুল কাশেম। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, কারিগরি শিক্ষার প্রসারে গত কয়েক বছরে দেশে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে সরকার। অনুমোদন দেয়া হয়েছে বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের। শিক্ষার্থী ভর্তিও বাড়ানো হয়েছে কয়েক গুণ। সে অনুপাতে বাড়ানো হয়নি শিক্ষক সংখ্যা। পর্যাপ্ত অবকাঠামোও গড়ে ওঠেনি। কারিগরি শিক্ষায় সবচেয়ে বড় সংকট দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের। এমনকি পর্যাপ্ত টেকনিক্যাল স্টাফও নেই। হাতে-কলমে শেখার জন্য নেই ল্যাব। এসব বিষয়ে নজর দিতে হবে। অন্যথায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে গ্র্যাজুয়েটরা চাকরির বাজারে ভালো করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।
পলিটেকনিক গ্র্যাজুয়েটদের বিষয়ে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি জানারও চেষ্টা করেছে বিশ্বব্যাংক। নিয়োগদাতাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় গ্র্যাজুয়েটদের কর্মদক্ষতা বিষয়ে। কারিগরি গ্র্যাজুয়েটদের নানা দুর্বলতার কথা জানান নিয়োগদাতারা। ৮০ শতাংশ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান পলিটেকনিক গ্র্যাজুয়েটদের ‘প্রবলেম সলভিং’ বিষয়ে আরো বেশি দক্ষতা প্রয়োজন বলে মত দেয়। এজন্য তারা মনে করে, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে আরো প্রশিক্ষণ দেয়ার সুযোগ রয়েছে।
প্রযুক্তি, ব্যবসা পরিবেশ, কারিগরি জ্ঞান—সবই প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সে অনুযায়ী হালনাগাদ করার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। তারা কী কারিকুলাম বা সিলেবাস অনুসরণ করছে, তা অনুসরণের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পার্টনারশিপ করতে হবে। এতে তাদের প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা জানার সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
কারিগরি শিক্ষার কোর্স-কারিকুলাম চাকরি বাজারের চাহিদার আলোকে সাজানোর ওপর জোর দেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ। তিনি বলেন, এখন কার ইন্ডাস্ট্রি ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কথা হচ্ছে। যদিও আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোয় এসব বিষয়ে কোর্স নেই। আবার যেসব কোর্স পড়ানো হচ্ছে, বাজারে সেগুলোর চাহিদা নেই। এই যখন অবস্থা, তখন গ্র্যাজুয়েটরা চাকরি পাবে কীভাবে? তাই আগামীতে কোন কোন খাতে জনবল দরকার হবে, তা নির্ধারণ করে কোর্স-কারিকুলাম খুলতে হবে।
এসব বিষয়ে নজর না দিয়েই বাড়ছে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৬ হাজার ৮৬৫টি। এতে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৪। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি শর্ট কোর্সের ২ হাজার ৬০০টি ট্রেনিং সেন্টারের শিক্ষার্থীদেরও মূল কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে যোগ করেছে। এসব ট্রেনিং সেন্টারের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ৮০ হাজার ৩০১। সে হিসাবে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৪৭ হাজার ৭৮৫।-বণিক বার্তা
/আরএম