করোনাদেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম

করোনাভাইরাস: যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে মিরপুরের টোলারবাগ

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ লকডাউন সঠিকভাবে মেনে কীভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব তার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন রাজধানীর টোলারবাগ এলাকার বাসিন্দারা। এপ্রিলের শুরুর দিকে করোনাভাইরাসের এলাকাভিত্তিক সংক্রমণের সবচেয়ে ঝুঁকিতে ছিল টোলারবাগ এলাকা। তবে, এলাকাবাসী সচেতন হয়ে জনসমাগম এড়াতে কঠোরভাবে লকডাউন মেনে চলেছেন। তার ফলাফলও পেয়েছেন তারা। শেষ ৩ সপ্তাহে ওই এলাকা থেকে নতুন করে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি।

যেখানে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে টোলারবাগ এলাকার বাসিন্দারা সঠিকভাবে সব নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেছেন।গত ২২ মার্চ ওই এলাকা লকডাউন করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। গত ১০ এপ্রিল এই এলাকা থেকে সর্বশেষ কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত এক রোগী শনাক্ত করা হয়। এরপর আর ওই এলাকায় কোনো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি।

যেভাবে শুরু

গত ২১ মার্চ টোলারবাগ এলাকায় বাসিন্দা ৭৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তখন সারাদেশের মানুষের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে রাজধানীর টোলারবাগ এলাকা।এর দুই দিন পর ২৩ মার্চ মৃত ওই ব্যক্তির এক প্রতিবেশির মৃত্যু হয়। পরে জানা যায়, ওই দুই ব্যক্তি মসজিদে একসাথে নামাজ পড়তেন।ওই দুই ব্যক্তির মৃত্যুতে ওই এলাকার বাসিন্দাদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন। তাদেরকে বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ করা। ওই এলাকার বসবাসরত প্রতিটি পরিবারকে হোম কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়।টোলারবাগ সোসাইটির পক্ষ থেকেও বাসিন্দাদের জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত বাড়িতেই থাকার আহ্বান জানানো হয়।

ওই এলাকায় মোট ৪০টি আবাসিক ভবন আছে। গত ৪ এপ্রিল, ওই এলাকার ৬ ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানানো হয়। ৯ এপ্রিল ওই এলাকায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ জনে। ১০ এপ্রিল আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ জনে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ৫০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু সবারই নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসে।

যেসব পদক্ষেপে থেমেছে সংক্রমণ

ঢাকায় লোকজনের চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনা হয় প্রথম টোলারবাগ এলাকাতেই। করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা প্রথম ব্যক্তি যে ভবনে থাকতেন সেখানকার বাসিন্দা নাজমুস সাকিব সেই সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন, “প্রথমেই কাজের লোকসহ যেকোনো ধরনের বহিরাগতদের এলাকায় প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। টোলারবাগে ঢোকার প্রধান ফটকটি বন্ধ করে রাখা হয় যাতে কোনও বহিরাগত এলাকায় প্রবেশ না করতে পারে।

সাকিব আরও বলেন, “স্থানীয় বাড়ি মালিক সমিতি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকানগুলো শুধুমাত্র দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় খোলার রাখার ব্যবস্থা করে। এছাড়াও মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি কারও নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু কেনার প্রয়োজন পড়ে তাহলে ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তাকর্মী কিংবা পরিবারের নির্ধারিত একজন সদস্য বের হতে পারবেন বলে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। যেটা এলাকাবাসী অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।“

স্থানীয় বাড়ি মালিক সমিতির সভাপতি শুভাশিস বিশ্বাস বলেন, প্রথমে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা লোকদের করোনাভাইরাস পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে কাজ করা হয়েছে। এছাড়াও প্রতিটি ভবনের নিরাপত্তা কর্মী ও এলাকার মসজিদে যারা নামাজ আদায় করেছেন তাদেরকে পরীক্ষা করা হয়।

শুভাশিস বিশ্বাস বলেন, “এভাবে প্রথমে প্রায় ৩০০ লোকের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়। এদের মধ্যে ১৯ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়। প্রতিবেশী ওই দুই ব্যক্তি বাদে এই এলাকায় আক্রান্ত বাকি ১৭ জন রোগীই সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরেছেন।““সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা ওই ১৭ জনের মধ্যে ৮ জন হাসপাতালে ও ৯ জন বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন,” যোগ করেন তিনি।

শুভাশিস জানান, এলাকায় অবস্থিত সুপারশপ স্বপ্ন ও স্থানীয় মুদি দোকানগুলোর ফোন নম্বর সব বাসায় জানিয়ে দেয়া হয়। কারও কিছু প্রয়োজন পড়লে তারা যেন একটি ফোন কলের মাধ্যমেই তা নিজের দরজায় পেয়ে যান সেটা নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপ নেয়া হয় বলে জানান তিনি। এই পদক্ষেপের কারণে এলাকার বাসিন্দাদের বাড়ির বাইরে যাওয়ার বিষয়টি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।এর পাশাপাশি এলাকায় প্রবেশের সবগুলো গেইট ২৪ ঘণ্টা বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করা হয় এবং প্রতিটি ভবনে প্রবেশ ও বের হওয়ার ক্ষেত্রে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়। এসবের পাশপাশি প্রতিদিন এলাকার রাস্তাগুলোতে জীবানুনাশক ছিটিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। এই কাজের জন্য সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান বাড়ি মালিক সমিতির সভাপতি।

এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) আসলামুল হকের দেয়া দুইটি জীবানুনাশক যন্ত্র এলাকাকে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখতে ব্যবহার করা হয়।এছাড়াও এমপি দুই দফায় ওই এলাকার বসবাসরত ৭০০ পরিবারকে খাবার পাঠান। পাঠানো খাদ্য সামগ্রীকে বাড়িতে থাকার জন্য উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন আসলামুল হক।

শুভাশিস বিশ্বাস বলেন, “আমরা এখন এলাকার বাসিন্দাদের ব্যক্তিগত গাড়িগুলোতে স্টিকার লাগানোর পরিকল্পনা করছি যাতে এলাকায় প্রবেশের সময়ই তাদের গাড়িতে জীবানুনাশক ছিটিয়ে এলাকায় সংক্রমণ থামানো যায়।“তিনি আরও বলেন, “উত্তর টোলারবাগের পেছনেই একটি বস্তি রয়েছে। সেখানে ১৬৬টি পরিবার বাস করে। এমপি’র পক্ষ থেকে তাদেরকেও দুই দফা খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। তারাও লকডাউন মেনে বাড়ি থেকে বের হননি। বস্তিবাসীদের জন্য আরও দুই দফায় খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করা হবে।”

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিরপুর জোনের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার মাহমুদা আক্তার লাকী জানান, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারির পাশাপাশি এলাকাবাসী সহযোগিতা করায় টোলারবাগ এলাকায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।

/এন এইচ

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close