করোনাদেশজুড়ে

করোনাঃ তিন মাসের বাড়ি ভাড়া মওকুফের অনুরোধ

ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে গেছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বসবাসরত নিম্ন আয়ের মানুষ। মহামারির সময় এপ্রিল থেকে আগামী তিন মাসের বাড়ি ভাড়া ও ইউটিলিটি বিল মওকুফ করার জন্য তারা সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

অনেকে বলছেন, চাকরি ও ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ করে তারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। পরিবারকে খাওয়ানোর মতো পর্যাপ্ত টাকাও নেই তাদের কাছে। পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তারা জীবন-জীবিকার বিষয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের বেঁচে থাকার ও ব্যবসা চালিয়ে যেতে ইউটিলিটি বিল মওকুফের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

এদিকে, লকডাউনের সময় কাজ হারানো নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। বিশেষ করে রিকশা চালক, পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুর, হকার, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বিভিন্ন দোকান, মার্কেটের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৭ অনুযায়ী, শহরাঞ্চলে প্রায় ৪৪ শতাংশ আবাসিক বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, বাড়িভাড়া বাবদ মোট মাসিক ব্যয়ের ১৭.২৫ শতাংশ পর্যন্ত খরচ হয়। সেই সাথে ইউটিলিটি বাবদ মোট ব্যয়ের আরও পাঁচ শতাংশ যোগ হয়। অর্থাৎ একটি পরিবারের মোট মাসিক ব্যয়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশই বাড়ি ভাড়ার বাবদ শেষ হয়ে যায়।

ভাড়াটিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, রাজধানীর প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়াটিয়া এবং বাকি ১০ শতাংশ বাড়ির মালিক। লকডাউনের মতো পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকে। ভাড়াটিয়ারা এখন অনেক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।‘‘এই পরিস্থিতিতে তারা তাদের পরিবারকেই ঠিকভাবে খাওয়াতে পারছেন না, কীভাবে তারা ভাড়া দেবেন?’’

বাহার জানান, ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে তিনি অভিযোগ পেয়ে আসছেন যে, এই সঙ্কটের সময়ও বাড়ির মালিকরা তাদের কাছে ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। ভাড়া দিতে না পারায় রাজধানীর কাঁঠালবাগানে এক বাড়িওয়ালা রাতে ভাড়াটিয়া পরিবারকে ফ্ল্যাট খালি করতে বাধ্য করেন।

তিনি বলেন, ‘‘এমন মহামারির সময় আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বাড়ি ভাড়া ও ইউটিলিটি বিল যেন মওকুফ করা হয়। সরকার যদি আমাদের পাশে না দাঁড়ায় তবে আমরা বাঁচতে পারব না।’’আকিদুল ইসলাম নামে ফুটপাতের এক বিক্রেতা বলেন, পুরান ঢাকার বংশালে পরিবার নিয়ে তিনি একটি ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। তাকে ঘর ভাড়া বাবদ মাসিক আট হাজার টাকা দিতে হয়।

‘‘আমি প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা আয় করতাম। কিন্তু গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার ছুটি ঘোষণা করার পর থেকে আমার কোনো আয় নেই। ছেলেমেয়ের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে বাড়িওয়ালা ভাড়া দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। আমি জানি না কীভাবে ঘর ভাড়া দেবো এবং আমার পরিবারের জন্য খাবার কিনব,’’ যোগ করেন তিনি।এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী, বিশেষ করে যারা টিউশনি দিয়ে নিজেদের খরচ চালাতেন, তারাও অনেক সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসিক সুযোগ-সুবিধার তীব্র সঙ্কটের কারণে অনেক শিক্ষার্থীকে বাধ্য হয়ে কয়েকজন মিলে বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসুদ হাসান জানান, তাকে বাসা ভাড়া বাবদ মাসিক ছয় হাজার টাকা দিতে হয়। লকডাউনের কারণে টিউশন চলে গেছে। আমি দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছি এবং আমি কীভাবে বাসাভাড়া দেব জানি না।পুরান ঢাকার আল্লাহর দান বিরিয়ানি হাউজের মালিক বিল্লাল হোসেন বলেন, ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটিতে তার রেস্টুরেন্টে তেমন কোনো গ্রাহক নেই। এতে তার ব্যবসায় মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এই রেস্টুরেন্ট এবং আমার ফ্ল্যাটের ভাড়া হিসেবে মাসিক প্রায় ৭৬ হাজার টাকা দিতে হয়। ছুটি ঘোষণার পর থেকেই ব্যবসায় মন্দা চলছে। ভাড়া ও বিল পরিশোধ নিয়ে আমরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছি।

এদিকে বাড়ির মালিক রাবেয়া আক্তার রিপা জানিয়েছেন, মহামারি সংকটের সময় মানবিক দিক বিবেচনা করে তিনি দুটি পরিবারের ভাড়া মওকুফ করেছেন। তবে তিনি বলেন, ‘‘সরকার যদি ইউটিলিটি বিল মওকুফ না করে, তবে আমরাও বাড়ি ভাড়া মওকুফ করতে পারব না।’’নাজিরাবাজারের আরেক বাড়িওয়ালা মহসিন মিয়া জানান, তার একটি ছয়তলা বাড়ি আছে এবং তার ভাড়াটিয়ারা তাকে বাসা ভাড়া মওকুফ করার জন্য অনুরোধ করছেন।

তিনি বলেন, ‘‘সরকার যদি সকল বিদ্যুৎ, গ্যাস, এবং পানির বিল মওকুফ করে দেয়, তবে আমিও তিন মাসের জন্য ভাড়া মওকুফ করতে পারি।’’সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আয় বন্ধ থাকায় শহরের দরিদ্র মানুষরা বাড়ি ভাড়া নিয়ে এখন মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এমন অনেক বাড়িওয়ালা রয়েছেন যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং তারা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত স্বেচ্ছায় ভাড়াটিয়াদের বাড়ি ভাড়া মওকুফ করতে পারবেন। আবার অনেক বাড়িওয়ালাদের আয়ের প্রধান উৎস বাড়ি ভাড়া হওয়ায় তাদেরও ভাড়া মওকুফ করার ক্ষমতা নেই।

তিনি আরও বলেন, একটি সমস্যা হচ্ছে শহরের দরিদ্রদের জন্য সরকারের কোনো উপযুক্ত পরিকল্পনা নেই। সরকার শহরের চরম দরিদ্র ও দিনমজুরদের অনুদান দিতে পারে, যাতে তারা তাদের পরিবারের জন্য খাবার কিনতে এবং বাড়ি ভাড়া দিতে পারে।এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে শহরের প্রায় ৪০ লাখ দরিদ্র মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। তাদের পক্ষে পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করাই কঠিন। সরকার তাদের জন্য খাবার রেশনিং চালু করতে পারে।‘‘এনবিআর বাড়ির মালিকদের আয়কর কিছুটা মওকুফ করতে পারে, যাতে তারা তাদের দরিদ্র ভাড়াটিয়াদের বাসা ভাড়ার বোঝা থেকে মুক্তি দিতে পারে। এছাড়াও সিটি কর্তৃপক্ষ হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করতে পারে,’’ যোগ করেন তিনি।

/আরএম

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close