আমদানি-রপ্তানীদেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
এলএনজি কিনতে এক বছরে ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: স্থানীয় গ্যাসের আবিষ্কৃত মজুদ কমে আসছে। গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটানো হচ্ছে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (এলএনজি)। বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যটির ঊর্ধ্বমুখিতায় প্রতি বছর বাড়ছে আমদানি ব্যয়। গ্যাস অনুসন্ধানে অর্থের জোগান না হলেও আমদানিতে বিপুল ব্যয় পেট্রোবাংলার ওপর আর্থিক চাপ বাড়িয়ে তুলছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি বাবদ সংস্থাটির খরচ হয়েছে ৪৬০ কোটি ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ৪০ হাজার কোটির টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৬.৯৬ টাকা ধরে)।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) সম্প্রতি বৈশ্বিক এলএনজির বাজারে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পেট্রোবাংলার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববাজারে এলএনজির আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত অর্থবছরে সংস্থাটি পণ্য আমদানি বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে। গত ৩০ জুন সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে আনুমানিক হিসাবে এ ব্যয় ৪৬০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের অর্থবছরে এলএনজি আমদানি ব্যয়ের দ্বিগুণ। জ্বালানি বিভাগের হিসাব মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩৮ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা।
এলএনজি আমদানিতে বিপুল এ অর্থ ব্যয়ের তথ্য নিশ্চিত করেছেন পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও। মূলত সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যটির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়লেও এ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে সংস্থাটির।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, গত অর্থবছরে এলএলজি আমদানি ব্যয় বাবদ ৩৯ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশি দামেই তা কিনতে হয়েছে। দেশের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনেই এ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। তবে চলতি অর্থবছরে এ খরচ ব্যাপক হারে কমে আসবে।
তিনি জানান, স্পট এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় বর্তমানে দৈনিক ১০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে পেট্রোবাংলার। মাসের হিসাবে এ অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকা। আর বছর শেষে তা দাঁড়ায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। ফলে স্পট এলএনজি আমদানি কমানো গেলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে পেট্রোবাংলার।
দেশের সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় দৈনিক যে পরিমাণ গ্যাস সঞ্চালন করা হয় তার মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ এলএনজি। এ পরিমাণ গ্যাস কিনতেই সংস্থাটিকে রফতানিকারক দেশগুলোতে বিল পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে দীর্ঘমেয়াদি ও স্পট মার্কেট—দুটি উৎস থেকে এ অর্থ ব্যয় হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে আনুমানিক সাড়ে ৩৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি খরচ হয়েছে। এর মধ্যে এলএনজি আমদানি বাবদ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন থেকে পেট্রোবাংলাকে দেয়া হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদি ও স্পট এলএনজি আমদানি বাবদ পেট্রোবাংলা ব্যয় করেছে ২৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকার মতো। সব মিলিয়ে গত বছর এলএনজি আমদানি কার্যক্রমে ব্যয় ৩৮ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা।
এলএনজি আমদানিতে এ অর্থ ব্যয়ের একটি তুলনামূলক ব্যাখ্যা দিয়ে পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, গত অর্থবছরে এ সময়ে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজির প্রতি এমএমবিটিইউর দাম ছিল ৯-১০ ডলার, বর্তমানে তা ১৪-১৫ ডলার। একই সময়ে স্পট মার্কেটে দাম ছিল ২০-২৫ ডলার, বর্তমানে তা ৪২-৪৪ ডলার। ফলে দুই উৎস থেকেই আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।
এলএনজি আমদানি ব্যয় মেটাতে পেট্রোবাংলা নিজস্ব তহবিল ব্যবহারের পাশাপাশি অর্থ বিভাগ, এনার্জি সিকিউরিটি ফান্ড ও গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে ঋণ নিয়ে এ সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সর্বশেষ গত ৬ জুলাই এক কার্যপত্রে এলএনজি আমদানি বিল পরিশোধে সংস্থাটিকে জিডিএফ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেয়া হয়েছে। এর আগেও সংস্থাটি এলএনজি আমদানি করতে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নিয়েছিল।
গত বছর ইউরোপে শীত মৌসুম শুরু হলে সেপ্টেম্বরের শুরুতে বৈশ্বিক বাজারে গ্যাসের দাম ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। এরপর পণ্যটির দামে নানা সময়ে উত্থান-পতন হয়। সেই ধারাবাহিকতায় স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম চড়া হয়। চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। অল্প সময়ের জন্য স্পট এলএনজির দাম কমলেও তা পুনরায় চড়া হয়ে ওঠে। বর্তমানে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজির দাম ৪২-৪৪ ডলারে ওঠানামা করছে।
এলএনজি আমদানিতে সরকারের গ্যাস খাত পরিচালনার সিংহভাগ অর্থ চলে যাচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ অর্থের বড় একটি অংশ যদি দেশের স্থল ও সাগরভাগে গ্যাস অনুসন্ধান করা যেত তাহলে আরো বড় ধরনের গ্যাস মজুদের সম্ভাবনা তৈরি হতো। পেট্রোবাংলা গত অর্থবছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে এলএনজি আমদানিসংক্রান্ত কার্যক্রমে। অন্যদিকে একই অর্থবছরে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নকাজে বরাদ্দ ছিল ২৫০-৩০০ কোটি টাকার মতো। সেই হিসাব করলে দেশে এলএনজি আমদানির বিপরীতে ১ শতাংশও অর্থ ব্যয় করা হয় না অনুসন্ধান কার্যক্রমে।
দেশের স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স। সংস্থাটি নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে আলাদা করে কোনো বরাদ্দ থাকে না। বিভিন্ন প্রকার প্রকল্প গ্রহণ করা হলে তার ওপর ভিত্তি করে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। গত অর্থবছরে বাপেক্সের আওতায় পাঁচটি প্রকল্পে গত অর্থবছরের জন্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ ছিল। সেটির শতভাগ ব্যয়ও হয়েছে।
দেশে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট এবং স্পট মার্কেট থেকে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা করা হয়। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে গ্যাস আমদানি করা গেলেও উচ্চমূল্যের কারণে স্পট থেকে এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। আগামীতে খোলাবাজার থেকে পণ্যটি আমদানি করা যাবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই। ফলে দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় এলএনজির এ অস্থিতিশীল বাজার ব্যাপক হারে প্রভাব ফেলেছে। তার জন্য সরকারের আমদানিনির্ভরতাকে দায়ী করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে প্রায় দুই দশক ধরে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম নিয়ে কোনো উদ্যোগ ছিল না। জ্বালানি সংকটে আমদানি চ্যানেল বন্ধ হওয়ায় এখন দেশীয় উৎপাদনে জোর দিচ্ছে সরকার। অথচ কাজটি আরো অনেক আগেই করা উচিত ছিল। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ যথাযথ ব্যবহার করে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো গেলে আরো আগেই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানো যেত।