ঢাকা অর্থনীতি ডেস্ক: জুনের ৩ তারিখ যদি ছুটি নিতে পারেন, তাহলে এবারের ঈদে মে মাসের ৩১ তারিখ থেকে জুন মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত ৯ দিনের লম্বা ছুটি পাবেন। চাকরিজীবনে লম্বা ছুটি পাওয়া রীতিমতো স্বপ্নের ব্যাপার। এ রকম একটা বন্ধে সবারই ইচ্ছে করে পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব বা ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে কোনো দিকে ঘুরতে যেতে।
এই ঈদে পরিবার-বন্ধুবান্ধব বা প্রিয়জনকে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। বন, বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু, বনচারী মানুষের জীবন এবং জলপথে ভ্রমণ—এই সবকিছু একই সঙ্গে ঘটতে পারে সুন্দরবন গেলে। আর যদি আপনি খুব ভাগ্যবান হয়ে যান, তাহলে দেখা হয়ে যেতে পারে সুন্দরবনের রাজা বাঘমামার সঙ্গেও। তবে এটা বলে রাখা ভালো, সুন্দরবন গেলেই যে আপনি বাঘের দেখা পাবেন, সেটা বেশির ভাগ সময় না-ও ঘটতে পারে।
শুধু বাংলাদেশিরাই নন, সারা বিশ্ব থেকেই পর্যটকেরা আসেন সুন্দরবন দেখতে। আমাদের দেশের অনেক মানুষই বন পছন্দ করেন না, তাই যাওয়ার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন আপনার দলের সদস্যদের বনাঞ্চলের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে কি না। যাঁরা বন ভালোবাসেন, শুধু তাঁদেরই সুন্দরবন ভ্রমণে সঙ্গী করুন।
জাহাজে করে বনের মধ্য দিয়ে ঘোরার সময় চোখে পড়বে বিভিন্ন প্রজাতির নোনা পানির গাছ। সুন্দরবনে সহজেই দেখতে পারবেন বিচিত্র হরিণ, বানর, বন্য শূকর, কুমির ও নানা প্রজাতির পাখি। প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা প্রাণীদের বিরক্ত না করলে দেখতে পারবেন তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক। আপনি যদি সৌভাগ্যবান হয়ে থাকেন, তাহলে হয়তো দেখা পেতে পারেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রতীক হলুদ-কালো ডোরাকাটা বেঙ্গল টাইগারের।
বনের মধ্যে নৌকা নিয়ে ছোট ছোট খালে ঘুরতে যাওয়াটাও বড় ধরনের অ্যাডভেঞ্চার। মূলত, সুন্দরবন ভ্রমণ মানেই জলপথে ভ্রমণ। মাকড়সার জালের মতো সুন্দরবনে ছড়িয়ে রয়েছে ২০০টিরও বেশি নদী ও খাল। নদীপথে ঘোরার সময় বনের নীরবতা আপনাকে মুগ্ধ করবে। নৈঃশব্দ্য ভেদ করে বন্য পশুপাখির ডেকে ওঠা আপনাকে রোমাঞ্চিত করতে পারে। ঝোপঝাড়ে জীবজন্তুর নড়াচড়া কখনো কখনো আপনাকে শিহরিত করতে পারে। সেখানে যত গভীরে যেতে থাকবেন, নদী ও খালগুলো তত সরু হতে থাকবে আর আপনার গা ছমছম করে উঠবে।
ছোট খাল ধরে গহিনে ঢুকতেই আপনার কানে আসবে বন কোকিল, সিঁদুরে মৌটুসী, বনমালী, খয়রাপাক মাছরাঙা, বামুনি মাছরাঙা, কালোটুপি মাছরাঙাসহ হাজারো পাখির কলরব। পানির দিকে খেয়াল রাখবেন, কেননা সেখানে ঘোরাঘুরি করে বিশ্বের বিপন্নপ্রায় পাখি কালোমুখ প্যারা পাখি, স্থানীয় লোকজন যাকে ডাকে হাঁসপাখি নামে।
সুন্দরবনে গেলেই দেখতে পাবেন গোলপাতা সংগ্রহকারী মানুষদের। এ ছাড়া মৌয়ালদেরও দেখা পেতে পারেন। চাইলে তাঁদের কাছ থেকে কিনতে পারেন খাঁটি মধু। খুব কাছ থেকে দেখতে পারবেন জেলেদের জীবন। তখন আপনার মনে হয়ে যেতে পারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’–র জেলেদের কথা, তাঁদের জীবনের কথা।
বৃক্ষ, নদী-খাল, বৈচিত্র্যময় প্রাণী, আলো-আঁধারির খেলা, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, নৈঃশব্দ্য—সব মিলিয়ে সুন্দরবন রহস্যময় এক জায়গা, বাঘের উপস্থিতি সেখানে আপনাকে বাড়তি রোমাঞ্চ দিতে পারে।
সুন্দরবনের দর্শনীয় স্থান:
১. জামতলা সৈকত: জামতলার পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে সুন্দরবনের বেশ বড় অংশ একসঙ্গে দেখা যায়। সুযোগ হলে এখান থেকে বাঘের দেখা পাওয়া যেতে পারে।
২. মান্দারবাড়িয়া সৈকত: মান্দারবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়।
৩. হিরণ পয়েন্ট: হিরণ পয়েন্টে কাঠের তৈরি রাস্তায় হাঁটার সময় আপনি দেখতে পাবেন হরিণ, কুমিরসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী। মাঝেমধ্যে এখানেও বেঙ্গল টাইগারের দেখা মিলে যেতে পারে।
৪. দুবলার চর: সুন্দরবন এলাকার মধ্যে এটি একটি ছোট্ট চর।
৫. কটকা বিচ: পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর একটি সমুদ্রসৈকত এই কটকা বিচ। এখানে লাল কাঁকড়ার দেখা মেলে।
যা করবেন না
যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকবেন না। নইলে নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে পারেন। অনুমতি না নিয়ে বনে ঢুকলে আইনগত ও নিরাপত্তার সহায়তা আপনি নাও পেতে পারেন।
ভ্রমণ করতে গিয়ে আমরা কিছু সাধারণ ভুল করে থাকি। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, যেখানে–সেখানে প্লাস্টিকের প্যাকেট এবং পানির বোতল ফেলা। আপনাকে মনে রাখতে হবে, প্লাস্টিক পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই নির্দিষ্ট স্থানে আপনার ব্যবহৃত প্লাস্টিকজাত জিনিসপত্র, খাবারের প্যাকেট ইত্যাদি ফেলুন। অযথা কোনো কিছু নিয়ে কৌতূহল দেখাবেন না। উচ্চ শব্দ করে বন্য পরিবেশ এবং সেখানকার বাসিন্দাদের বিরক্তি উৎপাদন করবেন না।
যেভাবে যাবেন
দেশের যে প্রান্ত থেকেই যান না কেন, সুন্দরবন যেতে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে খুলনা। সেখান থেকে বাস কিংবা ভাড়া গাড়িতে করে যেতে হবে মোংলা। তারপর সুন্দরবন। সুন্দরবন দেখার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে খুলনা বা মোংলা থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে দুই–তিন দিনের জন্য চলে যাওয়া। জাহাজের ধরন, খাবারের মান, দিনের ওপর নির্ভর করে খরচ মোটামুটি জনপ্রতি ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পড়তে পারে। মোংলা বা খুলনা থেকে বুক করতে পারলে এ খরচ কিছুটা কমে যায়। হাতে যদি একেবারেই সময় কম থাকে, তাহলে মোংলা থেকে নৌকা ভাড়া করে করমজল গিয়ে কুমির প্রজনন কেন্দ্র ঘুরে আসতে পারেন।
লেখক: ভ্রমণবিষয়ক ফেসবুক গ্রুপের মডারেটর।