দেশজুড়েপ্রধান শিরোনাম
ঈদের পর নতুন মাত্রায় অর্থনীতি
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ চলমান কভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু করা হয়েছে প্রায় সব ধরনের শিল্প-কারখানা। খোলা হয়েছে শপিং মল, দোকানপাট। কিন্তু চাহিদা কমে যাওয়ায় জমছে না অর্থনীতি। এরই মধ্যে দরজায় এসেছে বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব কোরবানির ঈদ। ফলে ঈদের ছুটি-পরবর্তী অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা খোলার পর দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের নতুন মাত্রা যুক্ত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে উল্লেখযোগ্য হারে টাকার সরবরাহ বাড়বে। আবার কিছু মানুষের হাতে নতুন করে টাকা পৌঁছাবে। এরই মধ্যে নতুন নতুন রপ্তানি আদেশ আসতে শুরু করেছে।
ঈদের পর এসব আদেশের কিছু কিছু উৎপাদন ও শিপমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু হবে। ফলে থমকে থাকা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া আরও জোরদার হবে। দেশের জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রাখতে হলে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সরকারের সব উন্নয়ন কর্মকান্ড সচল রাখতে হবে। শিল্পের উৎপাদন বাড়াতে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারের নীতি ও অন্যান্য সহায়তা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে কভিড-১৯ সংক্রমণের গতি এখনো কমেনি। প্রতিদিনই বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু। তবে এর মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হয়েছে দেশে। অবশ্য এমন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হয়েছে সারা বিশ্বেই। এ পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনতে এবং কর্মসংস্থান বাড়াতে শিল্প খাতের চাকা সচল রাখার কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (কৃষি) স্বাভাবিক রাখতে কৃষকদের সহায়তা অব্যাহত রাখা এবং পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা সচল করা ও পণ্য পরিবহন খরচ কমানোও খুবই জরুরি। কভিড-১৯ এর কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পণ্য পরিবহন বা ডেলিভারিতে অনলাইন ব্যবস্থা জনপ্রিয় হচ্ছে। এজন্য অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য আরও বেশি বেশি নীতি সহায়তা এবং কর ছাড় দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কভিড-১৯ এর বিপর্যয় সামলাতে লক্ষাধিক কোটি টাকার কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। সেসব প্যাকেজের বাস্তবায়নও ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। উদ্যোক্তারা নতুন করে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরুর কথা ভাবছেন। অন্যদিকে কস্টকাটিংয়ের নামে অনেক নামি কোম্পানি তাদের কর্মীদের বেতন কমানোর পাশাপাশি কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছেন। তবে কর্মী ছাঁটাই কিংবা বেতন কমানোর সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য একদিকে যেমন উৎপাদন বাড়াতে হবে অন্যেিদক তেমন চাহিদাও বাড়াতে হবে। আর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কর্মীদের উদ্দীপনা বাড়াতে হবে। ফলে কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো সিদ্ধান্ত শিল্পের উৎপাদন কমিয়ে আনবে। আবার চাহিদা বাড়াতে হলে মানুষের হাতে টাকার সরবরাহ বাড়াতে হবে। ভোগের মানসিকা তৈরি করতে হবে। কিন্তু ব্যাপক হারে কর্মহীনতা তৈরি হলে মানুষের ভোগের মানসিকতা কমে যাবে, যা মূল চাহিদা কমিয়ে আনবে। এতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে অনেক সময় নেবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বন্ধ রাখা হয়েছে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যদিও প্রায় সব ধরনের অফিস-আদালত, দোকানপাট খোলা। ঘুরতে শুরু করেছে শিল্প খাতের চাকা। ব্যাংক ঋণের সুদের চাকাও ঘুরছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ফলে সামনের দিনগুলোতে শিল্প খাতের চ্যালেঞ্জটা আসছে আরও বড়। এজন্য শিল্প খাতকে নীতি সহায়তা দিতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। কেননা এখনো সারা বিশ্বই এক আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদিও সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল এর প্রভাব দীর্ঘায়িত হবে। কিন্তু এটা তো শুধু দীর্ঘায়িতই নয়, কখন শেষ হবে এর প্রভাব সেটা হয়তো এখনই বলা যাবে না। ফলে অর্থনীতিতেও প্রভাব অনেক বেশি। তিনি বলেন, বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। অনেক দেশেই আবার দ্বিতীয়বার সংক্রমণ বাড়ছে। ফলে অর্থনীতির ভবিষ্যৎটা বেশ কঠিনই হবে বলে মনে হচ্ছে। যদিও আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বেশ ভালো। বিশেষ করে বাম্পার কৃষি উৎপাদন আমাদের এগিয়ে রেখেছে অনেকটাই।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আগে থেকেই কতগুলো সংকট ছিল সেগুলো আরও জটিল করেছে কভিড-১৯ পরিস্থিতি। এর মধ্যে কর্মসংস্থান, অবকাঠামো, জ্বালানি, কর কাঠামো এগুলো বেশ পুরনো সমস্যা। এখন কভিড-১৯-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে হলে কর কাঠামোর পরিবর্তন আনতে হবে। করনীতি সহজ করতে হবে। করদাতাদের স্বাচ্ছন্দ্য দিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করতে হলে কিছু কিছু বিষয়কে ফ্রি করে দিতে হবে। তাহলে অর্থনীতিটা সম্প্রসারিত হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। উৎপাদন বাড়বে। নতুন নতুন চাহিদা তৈরি হবে। এজন্য প্রয়োজন করজাল বৃদ্ধি আর করহার কমানো। ব্যবসায়ীদের কিছু বিষয়ে স্বাধীনতা দিতে হবে। বিনিয়োগের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের অর্থের সংস্থানের জায়গা বরাবরই ব্যাংক খাত। এই একক খাত থেকে সরকার টাকা নেয় আবার বেসরকারি খাতও এই খাতের ওপরই নির্ভরশীল। এজন্য বিকল্প অর্থায়নের উৎস তৈরি করতে হবে। শেয়ারবাজার পুঁজি সংগ্রহের জন্য একটি উত্তম উৎস। সেখান থেকে পুঁজি তুলে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব। ফলে শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে আমাদের কিছু কাজ আরও করতে হবে। যেমন এ সংশ্লিষ্ট অনেক দফতরে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হয়েছে। এটাকে আরও কার্যকর করতে হবে। ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়াসহ আরও কিছু দেশের বিনিয়োগ নীতিকে আমরা মডেল হিসেবে কাজে লাগাতে পারি। তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্পের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে এটা কিছুটা হলেও স্বস্তিদায়ক। আমাদের কৃষি উৎপাদন ভালো হয়েছে এটাও স্বস্তির খবর। কিন্তু এখন বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ কভিড-১৯ এর সঙ্গে নতুন মাত্রার এক বিপদের মধ্যে রয়েছে তাদের সহায়তা দিতে হবে। একই সঙ্গে সামনের মৌসুমে যেন উৎপাদন ভালো হয় সেটাও মনে রাখতে হবে। সরকার যেসব প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন হতে হবে। শুধু উৎপাদন নয়, চাহিদাও বাড়াতে হবে। আর সরবরাহ চেইন সচল রাখতে অনলাইন ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলে সংক্রমণের ঝুঁকি কম থাকে। এজন্য পণ্য পরিবহন সহজ করতে হবে। যারা এখন অনলাইনে ব্যবসা করছেন তাদের জন্য একটা বড় বাধা হলো কুরিয়ার খরচ। এটা খুবই মনোপলি একটা বিজনেসে পরিণত হয়েছে। অনেক উচ্চ খরচ। এই খরচটা কমানো খুবই জরুরি। তাহলে প্রান্তিক পর্যায়ের একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাও খুব সহজে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এ ছাড়া ব্যাংকিং সিস্টেম আরও সহজ করা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যাতে সহজে ঋণ পেতে পারেন সে ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন যাদের বিকাশ অ্যাকাউন্ট আছে তাদের ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটাকে কার্যকর করতে পারলে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ফুটপাথের ব্যবসায়ী, তাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যবসাগুলোকে আবার চালু করতে পারবেন।