প্রধান শিরোনামবিশেষ প্রতিবেদনশিক্ষা-সাহিত্যস্বাস্থ্য

ইন্টার্নশিপ নিয়ে ডা. আব্দুন নূর তুষারের খোলা চিঠি

মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর খোলা চিঠি দিয়েছেন বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ডা. আব্দুন নূর তূষার। চিঠিতে তিনি সম্প্রতি মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপের সময়কাল বৃদ্ধি বিষয়ে কথা বলেছেন। এছাড়াও তিনি কথা বলেছেন ডাক্তারদের নানা প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে। পাঠকদের সুবিধার্থে ডা. আব্দুন নূর তূষারের খোলা চিঠিটি হুবুহু তুলে ধরা হলো-

প্রতি
যথাযথ কর্তৃপক্ষ
যারা খসড়া প্রজ্ঞাপণ দিয়েছেন মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ নিয়ে

জনাব

করজোড়ে বিনীত নিবেদন এই যে, অতি সম্প্রতি মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ এর সময়কাল বৃদ্ধির বিষয়ে একটি খসড়া প্রজ্ঞাপণ ফেসবুকে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ইন্টার্নশিপ এর সময় হবে দুবছর। এক বছর স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল হাসপাতালে ও একবছর উপজেলা হাসপাতালে ।

আপনাদের সুবিবেচনার জন্য কিছু বিষয়ে কথা বলতে চাই।

১. চিকিৎসা শিক্ষার অংশ হলো ইন্টার্নশিপ। এটা স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয়ে থাকে কারন একজন ছাত্র যখন মেধার ভিত্তিতে সরকারী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় তখন সে কোথায় ইন্টার্নশিপ হবে সেটার প্রতিশ্রুতি নিয়েই ভর্তি হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে যে ভর্তি হলো তাকে আপনি সলিমুল্লাহ মেডিকেলে ইন্টার্ন করতে পাঠাতে পারবেন না। সলিমুল্লাহ থেকে কেউ ঢাকা মেডিকেলে আসতে চাইবে না। কারন সে তার নিজের প্রতিষ্ঠানের উচ্চমানেই প্রশিক্ষণ পাবার অধিকার অর্জন করেছে। তেমনি বিশেষ কারন ছাড়া কেউ তার নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্ন করার অনুমতিও পায় না। উপজেলা হাসপাতাল কোন চিকিৎসা শিক্ষা হাসপাতাল না। সেখানে কোন মেডিকেল কলেজের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসার যে উচ্চমান, সেটা থাকে না। থাকে না বলেই জটিল রোগীকে মেডিকেলে পাঠাতে হয়। টার্শিয়ারি হাসপাতালে ট্রেনিং পাওয়া ছাত্র ছাত্রীর অধিকার। তাকে জোর করে উপজেলায় পাঠানো মানে মেডিকেল কলেজের সমমানসম্পন্ন শিক্ষক ছাড়া তাকে প্রশিক্ষনের নামে ভাঁওতা দিয়ে গ্রামে রাখার চেষ্টা। সকল উপজেলা হাসপাতালের মান ও সুবিধাদিও সমান না। ফলে প্রশিক্ষণে বৈষম্যও হবে।‍ কেউ লিখবে ট্রেইন্ড ইন ভেদরগঞ্জ , কেউ লিখবে ট্রেইন্ড ইন সাভার।

২. ডাক্তারদের প্রত্যাশা হলো সরকার উপজেলা হাসপাতালে চাকুরী দিয়ে পদায়ন করে চিকিৎসক পাঠাবেন। তাকে সেখানে রাখার জন্য পরিবেশ দেবেন। যন্ত্রপাতি দেবেন , সাহায্যকারী স্টাফ দেবেন। থাকা ও খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করবেন। যাতে চিকিৎসক সেবা দিতে পারেন। সেটা না করে প্রশিক্ষনার্থী চিকিৎসক দিয়ে সেবা দেয়ার চেষ্টা করা ছাত্র ও রোগীর সাথে এক ধরনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা।

৩. ডাক্তারী কোন একক কাজ নয়। সকল সুবিধাদি না থাকলে চিকিৎসক প্রেসক্রিপশন লিখতে পারেন কেবল , চিকিৎসা দিতে পারেন না। পরামর্শ দেয়া আর চিকিৎসা দেয়া এক কথা নয়। তাই ডাক্তার নাই তাই চিকিৎসা হয় না , এটা সঠিক নয়। ডাক্তার থাকলেও চিকিৎসা হয় না যদি এক্সরে মেশিন নষ্ট থাকে, নার্স না থাকে, ঔষধ সরবরাহ অপ্রতুল হয়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা ঢাকতে কেবল ডাক্তার আছে এটা বোঝানোর জন্য চাকুরী না দিয়ে ইন্টার্নদের বাধ্যতামূলক গ্রামে পাঠানোর জন্য তাদের ট্রেনিং দুবছর করা একটা অবিচার। ঢাল তলোয়ার ছাড়া শুধু প্রেসক্রিপশন দেয়া আর চেহারা দেখানোকে চিকিৎসা বলে না।

৪. ইন্টার্ন দু বছর করা মানে বিসিএস এর চাকুরীতে প্রবেশ করতে আরো এক বছর দেরী হবে সবার। কিন্তু এখনি নিয়ম আছে গ্রামে বা উপজেলায় ৩ বছর চাকুরী না করলে সরকারী ডাক্তাররা উচ্চশিক্ষা করতে পারেন না। ইন্টার্নরা এক বছর গ্রামে কাজ করার পরেও সেটা ৩ বছরই থাকবে কারন সেটা কমানোর কোন পরিকল্পনা নাই। তার মানে গ্রামে ৪ বছর। এটা কোন সমস্যা হতো না যদি উচ্চ শিক্ষাকে প্রমোশনের শর্ত হিসেবে সরকার না দেখতো। যেহেতু প্রমোশন পেতে হলে উচ্চ শিক্ষা দরকার তাই সকলেই সেই চেষ্টা করে। আর সেকারনেই উপজেলায় ডাক্তার সংকট দেখা দেয়। কারন শিক্ষা ছুটিতে যাবার পরে যে মেডিকেল অফিসার তার ডিগ্রি পায় সে উচ্চতর পদে ফেরে । বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ সংখ্যায় কম এবং উপজেলায় সব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা দিতেও পারেন না। ডাক্তারের সংকট দেখা দেয়। এমনিতেই তিন শিফটে কাজ করার জন্য যথেষ্ট জনবল নাই। ফলে সরকার এখন চাকুরী না দিয়ে ইন্টার্ন পাঠাবেন। বিসিএস এ মেডিকেল অফিসার চাকুরী না দিলেও চলবে। এটা করলে চিরকাল গ্রামের জনগন ইন্টার্ন পাবেন , পরিপূর্ণ চিকিৎসা সেবা পাবেন না। ডাক্তারও চাকুরী পাবে না।

৫. ইন্টার্ন পাঠান যদি উপজেলায়, তবে নার্স , মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট , সবই কি শিক্ষানবিস পাঠাবেন?

৬. ইন্টার্নরা বিএমডিসি থেকে প্রভিশনাল বা অস্থায়ী রেজিস্ট্রেশন নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা দেন উচ্চতম পড়াশোনা করা অভিজ্ঞ শিক্ষকদের তত্বাবধানে। প্রভিশনাল রেজিস্ট্রেশন দিয়ে শিক্ষা হাসপাতালের বাইরে তত্বাবধান ছাড়া চিকিৎসা দেয়া যায় না। উপজেলা হাসপাতাল শিক্ষা হাসপাতাল না। তাহলে সেখানে তারা যে চিকিৎসা দেবেন সেটা কোন রেজিস্ট্রেশনের আওতায় দেবেন? কার তত্বাবধানে তারা চিকিৎসা দেবেন? যার বা যাদের তত্বাবধানে চিকিৎসা দেবেন তিনি বা তারা উপজেলায় থাকলে আর ইন্টার্ন লাগে কেন?

৭. ইন্টার্ন কেবল সরকারী হাসপাতাল থেকে হয় না। এখন অর্ধশতাধিক প্রাইভেট মেডিকেল থেকে যে ইন্টার্নরা পাশ করার পরে প্রশিক্ষন নেয়, তাদের বেতন ভাতা পরিশোধ হয় অভিভাবকের পয়সায়। একবছর ইন্টার্নের সময় যে বেতন সেটা প্রাইভেট মেডিকেলগুলি বাবা মায়ের পকেট থেকে আগেই নিয়ে নেয়। এখন কি তারা অতিরিক্ত এক বছরের জন্য আরো টাকা নেবে? সরকারী হাসপাতালে কাজ করলে বেতন বাপ মায়ের পকেট থেকে কেন যাবে? বেতন যদি সরকার দেয় , সেটাও বেঠিক কারন প্রাইভেট মেডিকেলের প্রশিক্ষণ ব্যয় করের টাকায় কেন হবে?

৮. সরকারী চাকুরীতে প্রবেশেও সবার আরো এক বছর দেরী হবে । তাহলে কি অবসরের সময় চাকুরীর মেয়াদ কাল ডাক্তারের জন্য ১ বছর বাড়বে? যদি না বাড়ে তবে ডাক্তার হবার জন্য সে কেন এক বছর কম চাকুরী করবে? এখনি সে দুবছর কম সময় পায়, ইন্টার্নশিপ দুবছর হলে সে তিন বছর কম চাকুরী করবে।

৯. প্রতি বছর ১০-১১ হাজার নবীন চিকিৎসক যদি গ্রামে যায়, তারা কোথায় থাকবে? এখনি কর্মস্থলে নিরাপত্তা নাই। এমনকি মেডিকেল কলেজে বহিরাগতদের উৎপাত ও ডাক্তার নির্যাতন এর ঘটনা ঘটেছে। এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশী ডাক্তার হয়। মেয়েদের নিরাপত্তা আরো বড় সমস্যা। এই বিরাট সংখ্যক ছেলে মেয়েদের বাসস্থান ও নিরাপত্তা কে দেবে? মেডিকেলে তারা কম খরচে হোস্টেলে থাকে , ক্যান্টিনে খায়। উপজেলাতে এসব কোথায় পাবে? এক ক্লাসের সবার একই মানের ট্রেনিং পেতে হলে ১৫০ জনকে একই উপজেলায় দিতে হবে। সেটা অসম্ভব।

১০. পদ খালি রেখে , প্রায় আট হাজার তিনশ ষাটজন ডাক্তারকে নন ক্যাডার বানিয়ে রেখে ইন্টার্ন দিয়ে চিকিৎসা দেয়ার পরিকল্পনা এক ধরনের স্যাবোটাজ। এভাবে ডাক্তারদের বেকার রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, সরকারী চাকুরীতে তাদের নিরুৎসাহিত করার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এভাবে চললে, মেধাবীরা ডাক্তারী পড়তে চাইবে না। কারন অন্য বিষয়ে মাস্টার্স করে অর্ধেক সময়ে বের হয়ে এসে কর্মজীবন শুরু করা যায়। যতো দিনে ডাক্তার গ্রাম থেকে পড়তে আসে, ততো দিনে পিএইচডি সহ শেষ করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীরা। তাহলে কেন ডাক্তারী পড়বে কেউ, যেখানে বেতন, সুবিধা কোথাও কোন প্রণোদনা নাই , উল্টো আছে মার খাওয়ার ঝুঁকি।

১১. গ্রামে ডাক্তার পাঠাতে হবে। সেজন্য মানব সম্পদ এর বই খুলে দেখেন কিভাবে জব স্যাটিসফ্যাকশন ও অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে কাজের গুনগত মান ও কর্মীকে রিটেইন করতে হয়।

১২. ইন্টার্নশিপ শিক্ষার সাথে জড়িত বিষয়। এটা চিকিৎসা সেবাদানের সাথে জড়িত বিষয় না। ইন্টার্নরা হাসপাতালে শেখেন, সেবাদান হলো সেকেন্ডারী বিষয়। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় গুলি থেকে বিভিন্ন বিষয়ে যারা ইন্টার্ন করেন তাদের কিন্তু সচিবালয়ে বা জেলা পরিষদে ইন্টার্ন করতে দেয় না সরকার। কেবল ডাক্তারের বেলায় শিক্ষা শেষ না করে, শিক্ষার নামে জোর করে সেবা দেয়ানোর চেষ্টা রোগীর প্রতিও অন্যায়।

১৩. যদি ডাক্তার পাঠাতে চান গ্রামে তবে সেবা অবকাঠামোর উন্নয়ন করেন। সকল পদে নিয়োগ দেন। সঠিক অনুপাতে বিছানা, নার্স ও স্টাফ দেন। যন্ত্রপাতি দেন। স্বাস্থ্য নিয়ে জবরদস্তি না করে যথাযথ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করেন। এক লাখ টাকার স্টেথো আর পঁচাশি হাজার টাকার বই নিয়ে যেসব সংবাদ বের হয়, সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত করেন। আবজল গাবজল নিয়ে চিন্তা করেন। (অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত স্বাস্থ্য বিষয়ক যন্ত্র ও উপকরণ সরবরাহকারী )

১৪. মেডিকেল শিক্ষাবিদ, ছাত্র ছাত্রী, অভিভাবক, গবেষক, সাধারন রোগী, সকল পক্ষের সাথে আলাপ আলোচনা না করে একপাক্ষিক নির্দেশ জারীর খসড়া দেয়া, একধরনের অগণতান্ত্রিক ও অনাধুনিক প্রক্রিয়া। স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বললেই এই সিদ্ধান্তের সমস্যাগুলি বোঝা যেতো।

১৫. এক ছেলে আকদ করেছে কিন্তু বউকে শ্বশুরবাড়ীতেই রেখে দিয়েছে। সে নিজে যাওয়া আসা করে কিন্তু বউকে নিজের বাড়ীতে নেয় না। এভাবে একদিন বাচ্চাও হয়েছে। সেই বাচ্চা স্কুলে ভর্তিও হয়েছে। ছেলে তার বন্ধুদের বলে শ্বশুরের খরচেই সব করলাম কিন্তু ঘরজামাই হলাম না। শ্বশুরবাড়ীতে বেড়াতে যাই , থাকি না।

গল্পটা বলার কারণ হলো , ডাক্তারী ভর্তি হয়ে পাশ করার পরে বিসিএস চাকুরী না দিয়ে, ইন্টার্ন করানোর নামে গ্রামে পাঠিয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে বাধ্য করা অনেকটা ওই ছেলেটার মতো কাজ।
চাকুরী দিলাম না, কিন্তু সব কাজই করালাম।

ছাত্র পাঠালাম , জনগনকে বোঝালাম ডাক্তার দিলাম। চিকিৎসা নিলাম কিন্ত চাকুরী দিলাম না। এরকম সিদ্ধান্ত নিলে ডাক্তার ও রোগী , দুপক্ষেরই অধিকার খর্ব করা হয়। হতাশাগ্রস্ত চিকিৎসক আর যাই হোক মানসম্পন্ন সেবা দিতে পারে না।

পত্র পছন্দ না হলে আশা করি মার্জনা করবেন।

বিনীত অনুরোধ, আমাদের পুত্র কন্যাদের ভালো ডাক্তার হবার পরে মেধার পুরষ্কার হিসেবে চাকুরী ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেবেন। তারপর সেবা নেবেন।

নিবেদক

আব্দুন নূর তুষার

#এমএস

Related Articles

Leave a Reply

Close
Close