দেশজুড়ে
ইনচার্জ হয়েও তার ভাব ছিল থানার ওসির মতোই
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ গায়ের জোরেই ফাঁড়ি চালাতেন সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া। টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে প্রতিদিন ফাঁড়িতেই সালিশ বসাতেন। তার আধিপত্য ছিল বন্দরবাজার এলাকাজুড়ে।
বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি ছিল আকবরের কাছে থানার মতোই। ইনচার্জ হয়েও তার ভাব ছিল থানার ওসির মতোই। একটু উনিশ-বিশ হলেই ফাঁড়ির টর্চার সেলে নির্যাতন করা হতো। সেই কক্ষকে বলা হতো আকবরের ‘ভিআইপি রুম’। এই ভিআইপি রুমে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বন্দরবাজার এলাকার হকাররা।
চাকরির পরোয়া না করেই অবৈধ টাকার পেছনে ছোটাই ছিল তার একমাত্র কাজ। সোর্স আর লাইনম্যানদের দিয়ে শুধু বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকেই প্রতি মাসে আকবরের অবৈধ আয় ছিল ৫ লাখ টাকা। কাজ না করেই অবৈধ টাকা দিয়ে আশীর্বাদ নিতেন পুলিশের বড় কর্তাদের।
শনিবার রাতে মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য ফাঁড়িতে নির্যাতন করে রায়হান উদ্দিন নামের যুবককে খুনের ঘটনার পর তার সেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও চুপ। এরপর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে আকবরের ভয়ংকর সব ঘটনা। রায়হানের মৃত্যুর পর বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেনসহ চার সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে আরো তিনজনকে।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ বলেন, পুলিশ ঘটনা তদন্ত করে যাদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তাদেরকে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই মামলার সার্বিক তথ্য এরইমধ্যে পিবিআইকে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন সবকিছু পিবিআই দেখবে।
এসআই আকবরের আত্মগোপনে চলে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের নির্দেশনা ছিল মহানগরী এলাকা না ছাড়ার জন্য। আমাদের পাশাপাশি পিবিআইও বিষয়টি তদন্ত করছে। এখন তারা তাকে গ্রেফতার করবে কিনা এটা তাদের বিষয়। অপরাধ করলে শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে বলেও মন্তব্য করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সোমবার বিকাল ৩টা ১০ মিনিট পর্যন্ত আকবর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতেই ছিলেন। তখন পর্যন্ত তাকে বেশ চিন্তিত দেখা গেছে। এরপরই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। আকবর তার নিজের ব্যবহৃত এবং সরকারি মোবাইল সেট দুটোই ফাঁড়িতে রেখে গায়েব হন। গা ঢাকা দিয়ে কোথায় আছেন, সেই হদিস কেউ দিতে পারছেন না। তবে অভিযুক্ত অন্য সদস্যদের পুলিশ লাইনে রাখা হয়েছে।
এএসআই আশেক এলাহি, কুতুব উদ্দিন, কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাশ, হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও সজীব এখন পুলিশ লাইনে বিশেষ নজরদারিতে আছেন। তবে রায়হান উদ্দিন হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি।
পুলিশ সূত্র জানায়, বন্দরবাজার ফাঁড়িকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দুই শিফটে চলে হকারদের ব্যবসা। সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ করলেও পুলিশ টাকা নিয়ে হকারদের রাস্তায় বসিয়ে দেয়। প্রতিটি হকারের কাছ থেকে ব্যবসা বুঝে আদায় করা হয় ৩০-৫০ টাকা। এই এলাকার রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে প্রতিদিন দেড় শতাধিক হকার ব্যবসা করেন।
এছাড়া ছিনতাইকারীদের কাছ থেকেও টাকা আদায় করতেন এসআই আকবর। সবচেয়ে বেশি টাকা নিতেন সিলেটের আপা সিন্ডিকেটের কাছ থেকে। এই চক্রের মূল হোতা পপি, মুন্নি, স্বপ্না ও মালা। চক্রটি সিলেটের বিভিন্ন মার্কেটে নারী ও পুরুষদের বেকায়দায় ফেলে মোবাইল ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নিতো। আকবর খবর পেলে আর রেহাই পেতো না পপি সিন্ডিকেটের সদস্যরা। যতক্ষণ না আকবরকে টাকা না দেয়া হতো ততক্ষণ আকবরের সোর্সরা তাদের খুঁজতো। টাকা পেলে সব অপরাধ মাফ।
আকবরের চাঁদাবাজির যন্ত্রণায় জুলাইয়ে অন্যত্র চলে যান এক এসআই। তিনি বলেন, প্রতিদিন রাতে সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তার জন্য টাকা আদায় করতে হতো। সন্ধ্যা থেকে রাত আড়াইটা তিনটা পর্যন্ত ফাঁড়িতে বসে থাকতো সে। ভোর পর্যন্ত ফাঁড়িতে ৩-৪ জন লোক ধরে না নিয়ে আসলে ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো। সবকিছুর শেষ আছে। এখন সে তার পাপের ফল ভোগ করছে।
এছাড়াও সুরমা মার্কেটের দুইটি, মহাজনপট্টি ও কালিঘাটের দুইটি এবং জিন্দাবাজারের দুইটি হোটেলে গোপনে নারী ব্যবসা চলতো। প্রতিটি হোটেল থেকে মাসে ৫ হাজার করে টাকা দিতে হতো আকবরকে। সিলেট নগরীর তালতলা, লালদিঘীরপাড়, কাষ্টঘর ও মির্জা জাঙ্গালের জুয়া ও মাদকের স্পট থেকে এসআই আকবর প্রতি সাপ্তাহে তিন হাজার টাকা করে আদায় করতেন। অভিযোগ রয়েছে কোনো কাজে আকবরের কাছে গেলে তিনি টাকা ছাড়া কথাই বলতেন না।
/এন এইচ