প্রধান শিরোনামশেয়ার বাজার
আয় কমেছে ডিএসইর, ৬ কর্মকর্তাই নিয়ে যাচ্ছেন ১১ শতাংশ বেতন
ঢাকা অর্থনীতি ডেস্কঃ দেশের শেয়ারবাজারে মন্দা চললেও উচ্চ বেতনে শীর্ষ পর্যায়ে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয়ের পাল্লা ভারী হলেও ব্যবসায় কোনো উন্নতি হচ্ছে না। উল্টো আয় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সুদ আয়ের ওপর ভর করেই কর্মকর্তাদের বেতন দিতে হচ্ছে।
ডিএসইর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ স্টক এক্সচেঞ্জে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৩৬০ জন। তবে প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (সিআরও) পদে বর্তমানে কেউ নেই। এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে বেতন হিসেবে প্রতি মাসে ডিএসইকে ৩ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে বছরে ব্যয় হচ্ছে ৩৮ কোটি টাকা।
এই অর্থের ১১ শতাংশই নিয়ে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ছয় কর্মকর্তা। এর মধ্যে রয়েছেন- ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও), প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) এবং দুই মহাব্যবস্থাপক (জিএম)।
এদের মধ্যে সিএফও এবং সিটিও পদ দু’টিতে দায়িত্ব পালনকারীরা প্রথমে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ডিএসইতে ঢোকেন। পরবর্তীতে তারা পদ স্থায়ী করে নেন। পদ স্থায়ী করা হলেও তাদের বেতন কাঠামো নতুন করে পুনঃনির্ধারণ করা হয়নি। বরঞ্চ চুক্তিভিত্তিক উচ্চ বেতনের সঙ্গে তারা নিয়মিত কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা নেয়া শুরু করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসইর এমডির পেছনে প্রতি মাসে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হচ্ছে ১২ লাখ টাকা। ২ লাখ টাকা মূল বেতনে নিয়োগ পাওয়া সিএফও এখন মোট বেতন নিচ্ছেন ৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এর সঙ্গে গ্রাচ্যুইটি, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল, কার রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রাইভার, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বীমা প্রিমিয়াম, মোবাইল বিল মিলিয়ে প্রতি মাসে আরও প্রায় ২ লাখ টাকা পান তিনি। সব মিলিয়ে সিএফও’র পেছনে প্রতি মাসে ডিএসইর ব্যয় হচ্ছে ৭ লাখ ১৯ হাজার টাকা।
একই অবস্থা সিওও এবং সিটিও পদ দু’টির ক্ষেত্রেও। ২ লাখ টাকা মূল বেতনে ডিএসইতে যোগদান করা সিটিও বর্তমানে মোট বেতন পান ৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। ২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা মূল বেতনে যোগ দেয়া সিওও মোট বেতন পান ৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এর সঙ্গে গ্রাচ্যুইটি, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল, কার রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রাইভার, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বীমা প্রিমিয়াম, মোবাইল বিল মিলিয়ে প্রতি মাসে তারা আরও প্রায় ২ লাখ টাকা পান। ফলে এই দুই কর্মকর্তার পেছনেও প্রতি মাসে ডিএসইর সাত লাখ টাকার উপরে খরচ করতে হয়।
ডিএসইতে জিএম পদে রয়েছেন দু’জন। এদের মধ্যে একজন এক লাখ ১৩ হাজার টাকা মূল বেতনসহ মোট বেতন পান ২ লাখ ২৬ হাজার টাকা। আরেকজনের মূল বেতন এক লাখ টাকা। তিনি মাসে মোট বেতন পান ২ লাখ টাকা। এর বাইরে গ্রাচ্যুইটি, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল, কার রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রাইভার, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বীমা প্রিমিয়াম, মোবাইল বিল সুবিধাও রয়েছে।
শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের পেছনে এমন মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা হলেও ডিএসইর ব্যবসায় কোনো উন্নতি হচ্ছে না। উল্টো আয় কমছে। স্টক এক্সচেঞ্জের আয়ের প্রধান উৎস লেনদেন হলেও সুদজনিত আয়ের ওপর নির্ভর করেই চলছে ডিএসই। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিএসইর মোট আয় হয়েছে ২১৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিচালন বা ব্যবসা থেকে আয় হয়েছে ১০৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এফডিআর ও বন্ড থেকে সুদজনিত আয় হয়েছে ৯৩ কোটি ৭ লাখ টাকা ও সিডিবিএল থেকে ২৫ শতাংশ হারে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা লভ্যাংশ আয় হয়েছে। এছাড়া নানাবিধ আয় আছে ১৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে ডিএসইর এফডিআর ছিল ৬৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া বন্ডে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেছে ৯৪ কোটি টাকা, সিডিবিএলে বিনিয়োগ ৮১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ও বন্ডে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ ৮ কোটি টাকা। ক্লিয়ারিং ও সেটেলমেন্টের জন্য নবনিবন্ধিত সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডে (সিসিবিএল) ৪৫ শতাংশ মালিকানায় ১৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত স্টক এক্সচেঞ্জ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে ২০১৩ সালে ডিমিউচ্যুয়ালাইজড হওয়ার মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয় ডিএসই। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে স্টক এক্সচেঞ্জটিকে লভ্যাংশ বিতরণ করতে হচ্ছে। তবে ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সঙ্গতি না থাকায় নামমাত্র লভ্যাংশ পাচ্ছেন শেয়ার হোল্ডারা। প্রথম তিন বছর রিজার্ভ ভেঙে শেয়ার হোল্ডারদের ১০ শতাংশ করে লভ্যাংশ দেয় ডিএসই। তবে শেষ দুই বছরে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ব্যবসায় আরও খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েছে ডিএসই। কারণ এই অর্থবছরের পুরোটা সময়ই লেনদেনে ছিল মন্দা। এ পরিস্থিতিতে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ৬৬ দিন লেনদেন বন্ধ ছিল। ফলে এ হিসাব বছরে শেয়ার হোল্ডররা কোনো লভ্যাংশ পাবেন কি না তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে কর্মকর্তাদের বেতন কাটার পরিকল্পনা নিয়েছে ডিএসই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বিভিন্ন স্তরে ভাগ করে এই বেতন কাটার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে যাদের বেতন ৫০ হাজার টাকার কম তাদের ক্ষেত্রে কাটা হবে না।
এ বিষয়ে ডিএসইর একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘উপরের স্তরে মোটা বেতনে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হলেও, তাদের কাজের ফলাফল শূন্য। অথচ তাদের কারণেই ডিএসইর ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু হলেও তার দায় এসে পড়ে নিচের স্তরের কর্মকর্তাদের ওপর। বড় কর্মকর্তাদের বেতন সমন্বয় করলেই ডিএসইর ব্যয় অনেকটা কমে আসবে।’
এদিকে, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে শেয়ার হোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে ডিএসইর ১৮০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা করে ব্যয় হয়েছে। আর ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ৯০ কোটি ১৯ লাখ টাকা করে ব্যয় হয়েছে। সে হিসাবে ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে গেলেও ডিএসইকে ৯০ কোটি টাকার উপরে ব্যয় করতে হবে। তবে ডিএসইর আয়ের যে চিত্র তাতে রিজার্ভ ভেঙেও এবার লভ্যাংশ দেয়া সম্ভব হবে কি না- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএসইর শেয়ার হোল্ডার এক পরিচালক বলন, ‘শেয়ার হোল্ডার কোম্পানির মালিকরা ৫ শতাংশ লভ্যাংশও পাবে না, অথচ কর্মী কাড়িকাড়ি টাকা নিয়ে যাবে, এটা হতে পারে না। ডিএসইর অনেক কর্মকর্তা অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এগুলো সমন্বয় করা দরকার। আমরা সে উদ্যোগ নিয়েছি।’
/এন এইচ