রিফাত মেহেদী, বিশেষ প্রতিনিধিঃ গ্রামের দরিদ্র পরিবারের অভাব মেটাতে চাকরির লোভে প্রতারকের ফাঁদে পড়ে সহজ-সরল যুবকেরা প্রতারকের খাতায় নাম লিখাচ্ছে নিজেদের অজান্তেই। সাভারের আশুলিয়ায় অভিযান চালিয়ে এমন প্রতারক তৈরির কারখানা থেকে ১২ প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তাদের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে শতাধিক ভুক্তভোগী তরুণ-তরুণীকে।
চাকরি তো দুরের কথা, অনেকটা বন্দিশালার মত জীবন কাটাতে হয় এই চাকরি প্রার্থীদের। শর্ত দেয়া হয়, নতুন লোক নিয়ে আসলে, তবেই মিলবে কমিশন। ফলে বাধ্য হয়েই বন্ধু বা স্বজনদের ভুলভাল বুঝিয়ে তাদেরও নিয়ে আসে এই প্রতারকের আতুর ঘরে। নিজেরা বাঁচতে অজান্তেই প্রতারক হয়ে উঠে। এখান থেকে মুক্তি মিললেও হারানো টাকা কিভাবে ফিরে পাবেন, সেই ভাবনা যেন কুড়ে খাচ্ছে তাদের।
আশুলিয়ায় চাকরির নামে প্রতারণার অভিযোগে অভিযান চালিয়ে এন ডি বি ইন্টাঃ লিঃ এবং লাইফওয়ে বাংলাদেশ (প্রা.) লিমিটেড নামে ভুয়া এমএলএম কোম্পানির সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের ১২ সদস্যকে আটক করে র্যাব-৪ সদস্যরা। এসময় ১০৪ ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়। আটককৃতদের আশুলিয়া থানায় হস্তান্তর করে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) বিকেলে র্যাব-৪ এর নবীনগর ক্যাম্পে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, প্রতারণার ফাঁদে ফেলে বিভিন্ন মানুষের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) সকালে সিপিসি-২, র্যাব-৪ এর একটি দল মেজর শিবলী মোস্তফা ও সিনিঃ এএসপি উনু মং এর নেতৃত্বে আশুলিয়ার জামগড়া, ভূইয়া ন্যাশনাল প্লাজা-৩ এর ২য় তলায় অভিযান পরিচালনা করে প্রতারক চক্রের ১২ সদস্য গ্রেফতার করে এবং প্রতারণার শিকার ১০৪ জন উদ্ধার করে। পরে আটককৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও জব্দকৃত নথিপত্র পর্যালোচনা করা হয়।
আটককৃতরা হলেন, ১) সিরাজগঞ্জর উল্লাহপাড়ার সিমলা থানাধীন মকবুল হোসেনের ছেলে মোঃ মেহেদী হাসান (৩০), ২) বগুড়া জেলার গাবতলী থানার মোঃ রশিদের ছেলে মোঃ রায়হান (২৫), ৩) কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানার বিস্ট পদ দে’র ছেলে জিসু কান্তি দে (২০), ৪) রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার মৃত আলী আকবর এর ছেলে মোঃ আকাশ (২২), ৫) দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ থানার ধীরেন বায় এর ছেলে প্রদিপ (২১), ৬) রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার মোঃ জালাল উদ্দিন এর ছেলে মোঃ মারুফ হোসেন (২৩), ৭) রাজশাহী বাগমারা থানার আফাজ উদ্দিনের ছেলে আল আমিন (২২), ৮) বরগুনা জেলার আমতলী থানার মৃত আঃ রাজ্জাকের ছেলে মোঃ সোহেল (২৫), ৯) টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর থানার চাঁন মিয়ার ছেলে আরিফুল (২২), ১০) ঠাকুরগাঁও সদর থানার গপেশ সরমা’র ছেলে জয়ন্ত সরমা (২১), ১১) ময়মনসিংহ জেলার ধৌবাউড়া থানার শেখ সাহাবুদ্দিন এর ছেলে মোঃ রায়হান (২০), ১২) টাঙ্গাইলের মধুপুরের জোয়াত আলীর ছেলে মোঃ শরিফুল ইসলাম (২২)। তারা সকলেই আশুলিয়ার জামগড়া সহ বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো।
প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা কেউ ছিলেন ছাত্র, কেউ পেশায় ব্যবসায়ী কেউবা গার্মেন্টস কর্মী। আগের চাইতে ভালো পেশার ও উন্নত জীবনযাত্রার লোভে পরে আটকে গেছেন ফাঁদে। কথা হয় এমন এক ফাঁদে পরা ভুক্তভোগীর সাথে। নাম তার খোদেজা বেগম, গ্রামের বাড়ি জামালপুরে। তিনি বলেন, মার্কেটিং সেকশনে অফিসিয়াল ফাইলপত্র দেখাশোনার কাজ করার কথা বলে আমাকে এখানে ৫০ হাজার টাকা জামানত নিয়ে চাকরি দেয়।
“বন্ধু তোর গার্মেন্টসে চাকরি করতে তো অনেক কষ্ট হয়, আমার কোম্পানিতে চলে আয় ভালো থাকবি।” বন্ধুর কাছ থেকে এমন প্রস্তাব ফেরাতে পারেননি গার্মেন্টসকর্মী নাটোর জেলার মোঃ সজীব হোসেন। তিনি আরও বলেন, বন্ধু বলেছিল ৩৫ হাজার টাকা দিতে হবে। মাস গেলে ১৪ হাজার টাকা বেতন দেবে এবং থাকা খাওয়া কোম্পানীর। আমি আমার বন্ধুকে বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছি কিন্তু এখানে এসে দেখি এসব কিছুই না। লোক আনতে পারলে টাকা পাব, প্রমোশন পাব। আমার মত সবারই এই অবস্থা।
শুধুমাত্র জামানত নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি এই প্রতারক চক্র। তারা এই মানুষগুলোকে মোটামুটিভাবে গৃহবন্দী করে কড়া নজরদারীর মধ্যে রাখতো। শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ।
প্রতারক তৈরীর ওই কার্যালয় থেকে ১২টি মোবাইল, একটি ডেস্কটপ, বিপুল পরিমাণ ভুয়া ভর্তি ফরম, নিয়ম ও শর্তাবলি ফরম, পণ্য ক্রয়ের ভাউচার, আপসনামা, অঙ্গীকারনামা, সাপ্তাহিক হিসাব রেজিস্টার, টাকা জমার রশিদ, স্ট্যাম্প, হাজিরা বই ও পণ্য সরবরাহের চুক্তিপত্র উদ্ধার করা হয়।
/আরএম