প্রধান শিরোনামবিশেষ প্রতিবেদন
আশুলিয়ার অপহরণ রহস্য, তেতুলিয়ায় উৎঘাটন
রিফাত মেহেদী, বিশেষ প্রতিনিধি: গত ২১ মে। আশুলিয়ার জামগড়ায় ব্যাংক থেকে ৬ লাখ টাকা তোলেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আবেদ আলী। তারপর বাইপাইল। এরপর নিরুদ্দেশ। মোবাইফোন বন্ধ। উৎকন্ঠা নিয়ে মিরপুর থেকে আশুলিয়া থানায় ছুটে আসেন বড় ভাই মনির হোসেন। পুলিশের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। দিনে-দুপুরে টাকাসহ ব্যবসায়ী অপহরন। রোজার মাস। ক্লান্ত শরীর, তবে এতো বড় ঘটনা। না ছুটতে হবে, শেষ অবদি। ততক্ষনে নির্দেশনা চলে এসেছে উধ্বর্তন কর্মকর্তার। বড় ভাই মনির হোসেন কয়েকজনকে আসামী করে অপহরন মামলা দায়ের করেন। তার ওপর সামনে ঈদ। যাই হোক জন-নিরাপত্তার দায়িত্বের চেয়ে বড় কাজ তো আর নেই। এমন শপথই তো নিয়েছি। ভুলে যাই কি করে। –এমন ভাবেই ঘটনার বর্ননা করেন আশুলিয়ার থানার এস আই মনিরুজ্জামান মোল্লা।
ভিডিও দেখুন: গত ২১ মে আশুলিয়ার জামগড়ার ব্যাংক থেকে টাকা তুলছেন ব্যবসায়ী আবেদ আলী। ( যিনি ফোনে কথা বলছেন, ঠিক কাউন্টারের সামনে। আর পিছনে গেঞ্জি পড়া ও হাত ভাজ করে দাড়িয়ে থাকা মানুষটি অপরাধী বলে প্রাথমিকভাবে চিহিৃত করেছে পুলিশ)
তিনি আরও জানান, তদন্ত শুরু হলো, শুরু থেকে। ব্যাংকের সিসি টিভির ফুটেজ। টাকা তুলছে। তার পিছনে সন্দেহভাজন ব্যক্তি। তারপর মোবাইল ফোনের কল লিস্ট। ছোট অক্ষরগুলোতে বড় চোখের নিখুত দৃষ্টি দিলাম। শেষ কার সাথে কথা, কি কথা? উত্তর খুঁজতে তাদের দরজায় কড়া নাড়া। নরম-গরম সবই হলো, তাদের কাছ থেকে কোন সূত্রই পাওয়া গেলো না। আবারও প্রযুক্তির সহযোগিতা। হা, এইতো পাওয়া গেলো। আবার দৌড়ঝাপ। না, সূত্র মিলছে না। আবার আটকে গেলাম। ঈদ আসলো। গ্রামের পথ চেয়ে বসে থাকা বাবা-মায়ের কাছে যাওয়া হলো না। স্ত্রী ও মেয়ে শাহেবা জামান নিয়েই ছিলাম, সাথে থাকলেও, মন ছিলো দুরে।
এভাবে রাত গড়িয়ে সকাল। আবার বিকেল। এবার বড় কর্মকর্তারা চাপ। আর কতদিন, একজন লোক বের করতে কতদিন লাগে? না পারলে বলে দাও। অন্য ব্যবস্থা নিবো। আমার বিগত কাজের দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ, যেন ক্ষুরধার তলোয়ারের নিচে। বেশি দিন হয়নি, ভালো কাজ ও এমন কাজের তদন্তে পেয়েছিলাম সাহসী পুরস্কার পিপিএম মেডেল। তাহলে? বার বার স্যারদের প্রশ্নগুলো তীরের মতো বুকে গাঁথছে। নিরব রক্ত ক্ষরণের, ত্নীক্ষ ব্যাথা। তবুও ভেঙ্গে পড়িনি।
আমার তদন্তে এই অপহৃত বা নিখোঁজ ব্যবাসায়ী রহস্য ঘেরা মানুষ হিসেবে ধরা দিলো। স্যারদের বলি, এটা অন্যকিছু। অপহরন না। স্যারদের এক কথা, চাই ফলাফল।
একদিন, দুইদিন, সপ্তাহ-এভাবে দুইমাস। এরমধ্যে নিখোঁজ আবেদ ফোন করে তার ঘনিষ্ট বন্ধু পলাশকে। পলাশের ফোন ইতিমধ্যে নজরদারি রেখেছিলাম। আর যায় কই। আবেদ আছে দেশের শেষ প্রান্ত তেতুলিয়ায়, খুলবে আমার রহস্যের জট। টিম নিয়ে সাথে সাথেই রওয়ানা হলাম। যেন স্বপ্ন জয়, দক্ষতার পুন:জীবন।
পৌছে গেলাম। দেশের শেষ প্রান্ত পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ার বানিয়াপাড়া। খোলা চোখেই দেখা যায় ভারতীয় সীমান্ত। অনুভব করলাম, অপরাধ চক্রের শক্ত অবস্থান এখানে। রীতি-মতো অবাক। দিব্যি আছেন সেই ব্যবসায়ী আবেদ। একদম জামাই আদরে। শরীর স্বাস্থ্য আগের চেয়ে আরও ভালো। হচ্ছেটা কি?
যাই হোক, মাথা ঠান্ডা রেখে তদন্তের শেষ অংশটুকু শুরু করি। তাকে আশ্রয় দেয়া ব্যক্তিরা কোন অপহরনকারী নয়। তারা মুলত আবেদকে আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু কেন? সে উত্তর এখানে রহস্যজালেই থেকে গেলো অনেকটা। খোলা বিলের মাঝখানে টিনসেড ঘরেই আবেদ বসবাস করেছেন এতোটা দিন।
ভিডিও দেখুন: তেতুলিয়ার বানিয়াপারার মাইনুল ইসলামের এই বাড়িতে আত্নগোপনে ছিলেন আবেদ আলী।
আবেদকে নিয়ে আসা হলো। জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের নতুন মোড়। তিনি জানান, টাকা তুলে আশুলিয়ার বাইপাইলে পৌছালে কে বা কারা তার টাকা নিয়ে যায়। তারপর বড় ভাই ও ব্যবসায়ীর ভয়ে নিজেই আত্নগোপনে চলে যায়। নিজের মোবাইলফোন সেইদিনই ফেলে দেন। টাকা নেয়ার ঘটনায় যুক্ত আছেন, এমন দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আগেই।
ব্যবসায়ী আবেদ আলী জানান, আশুলিয়ার বাইপাইলের একটু আগে দুর্বৃত্তরা টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে ভয়ে নিজেই আত্নগোপন চলে যান। কিভাবে তিনি তেতুলিয়া পৌছালেন এমন প্রশ্নে, আমি প্রথমে রংপুর যাই। সেখানে পাথর ব্যবসায়ী মাইনুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই সূত্র ধরেই তেতুলিয়া যাওয়া।
বানিয়াপাড়ার আশ্রয় দাতা মাইনুল ইসলামের ছেলে জিয়াউল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, বিপদে পড়েছে এমন কথা শুনে আশ্রয় দিয়েছি। আমরা যখন বলতাম, যে আপনার ভাই বা পরিবারকে ফোন দিন। আবেদ বলতো, সমস্যা আছে, ঈদের পর ফোন দিবো।
এ বিষয়ে আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) জাবেদ মাসুদ জানান, প্রাথমিক ভাবে ধারনা করা হচ্ছে নিজেই আত্নগোপনে ছিলেন। তবে টাকা হারিয়েছে বা কেউ নিয়ে গেছে কিনা, সেসব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে নিশ্চিত হওয়া যাবে মুল ঘটনা।